সাদাস্রাব মেয়েদের যোনিপথ (vagina) থেকে নিঃসৃত একধরনের চটচটে তরল। এটি একটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। পিরিয়ড তথা ঋতুস্রাবের আগে বা পরের সময়ে এই নিঃসরণ হতে পারে। সাধারণত কিছু গ্রন্থি ও জরায়ু থেকে এই তরলটি বাইরে আসে। এটা সাধারণত কোনো ক্ষতি করে না। কাপড়চোপড়ও নষ্ট করে না। বেশিরভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রেই এটি খুব সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। তবে অতিরিক্ত ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা সাদাস্রাব যখন হয়, তখন তাকে লিউকোরিয়া (Leucorrhea) বলে।
বিভিন্ন কারণে সাদাস্রাবের সমস্যা হয়। তবে এই সমস্যা সবসময় রোগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণে সাদাস্রাব হয়ে থাকে। সাদস্রাব যৌনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তবে অস্বাভাবিক সাদাস্রাব যোনিপথের ক্যান্সার বা সারভাইকাল ক্যান্সারের লক্ষণও হতে পারে। তাই সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু লজ্জা বা সংকোচের কারণে সবথেকে বেশি অবহেলা করা হয় এই সমস্যাকে।
Table of Contents
সাদাস্রাবের প্রকারভেদ
স্বাভাবিক সাদাস্রাব সাধারণত পাতলা, চটচটে ও জলের মতো স্বচ্ছ হয়। এই সাদাস্রাবে দুর্গন্ধ থাকে না। তবে জীবাণু সংক্রমণের কারণে বা অন্য কোনো রোগের কারণে হলে দুর্গন্ধযুক্ত, গাঢ় এবং হলুদ বা সবুজাভ রংয়ের স্রাব হয়ে থাকে।
১) সাধারণ শারীরবৃত্তীয় সাদাস্রাব
এটি জলের মতো স্বচ্ছ বা সাদা, চটচটে এবং দুর্গন্ধবিহীন হয়।
২) অতিরিক্ত ঘন সাদাস্রাব
স্বাভাবিকের থেকে ঘন সাদাস্রাব হলে চুলকানি থাকতে পারে। সাধারণত ইস্ট জাতীয় ছত্রাক সংক্রমণের কারণে এটি হয়।
৩) হলদে স্রাব
হলদে স্রাব একেবারেই স্বাভাবিক নয়। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া ঘটিত যৌনসংক্রমণের (sexually transmitted infection) কারণে এটি হয়ে থাকে। বিশেষত একাধিক যৌনসঙ্গী থেকে থাকলে, এই জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৪) খয়েরি স্রাব
বিশেষ করে মেনোপজের ঠিক আগের সময়ের দিকে বা পরে এই জাতীয় স্রাব হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে খয়েরি স্রাব হলে বিপদ সংকেত বুঝতে হবে। অনেক সময়ই, সারভাইকেল ক্যান্সারের (cervical cancer) অন্যতম লক্ষণ এই খয়েরি স্রাব। তাই খয়েরি স্রাবের ক্ষেত্রে শীঘ্রই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫) সবুজাভ স্রাব
এটিও একটি অস্বাভাবিক ধরণের স্রাব। ট্রাইকোমোনাস (Trichomonas) জাতীয় প্রোটোজোয়া সংক্রমণের ফলে এই জাতীয় স্রাব হয়ে থাকে। এটিও একধরনের যৌনসংক্রমণ বা Sexually Transmitted Infection (STD)।
অতিরিক্ত সাদাস্রাবের অন্যান্য লক্ষণ
দুর্গন্ধ ও রঙের তফাৎ ছাড়াও অতিরিক্ত সাদাস্রাবের ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়, সেগুলি হল –
- যোনিপথে চুলকানি
- তলপেটে ব্যথা
- ঘন ঘন প্রস্রাব
- জ্বর (সাধারণত নিম্ন মাত্রার জ্বর)
- শারীরিক মিলনের সময় অতিরিক্ত ব্যথা ও জ্বালাভাব
- পিরিয়ড বা মাসিকের সময় ব্যাথা
- অল্প পরিশ্রমেই অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব
- মাথার যন্ত্রণা ও মাথাঘোরা
- বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য
- রক্তাল্পতা
আরও পড়ুন :
(১) কাঁচা লঙ্কা খাওয়ার উপকারিতা
(২) টমেটো খাওয়ার উপকারিতা
(৩) আদা খাওয়ার উপকারিতা
(৪) খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা
(৫) শালদুধ বা কলোস্ট্রাম কী? জেনে নিন এর উপকারিতা।
অতিরিক্ত সাদাস্রাবের কারণ
অতিরিক্ত সাদাস্রাবের কারণ বিভিন্ন হতে পারে। যেমন –
- অপুষ্টি (Malnutrition)
- ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত যৌনসংক্রমণ (Bacterial STD)
- গণোরিয়া (Gonorrhoea)
- ইস্ট জাতীয় ছত্রাক সংক্রমণ (Yeast infection)
- ট্রাইকোমোনাস সংক্রমণ (Trichomonas infection)
- যোনিপথে রাসায়নিক সাবানের ব্যবহার (using soap in vagina)
- গর্ভনিরোধক বড়ি (Birth control pill)
- অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Antibiotic misuse)
- মধুমেহ রোগ বা ডায়াবেটিস (Diabetes)
- একাধিক যৌনসঙ্গী (Multiple sex partners)
- সারভাইকাল ক্যান্সার (Cervical Cancer)
সাদাস্রাব হলে কী করবেন?
১) প্রথমত, অতিরিক্ত সাদাস্রাব হলে কখনই অবহেলা করবেন না। অতি অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যোনিপথে লাগানোর মলম ব্যবহার করবেন বা মুখে খাওয়ার ওষুধ খাবেন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাবেন না। বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
৩) যতটা সম্ভব শিথিল পোশাক পরুন। সুতির অন্তর্বাস ব্যবহার করুন। অতি অবশ্যই শুকনো অন্তর্বাস ব্যবহার করুন।
৪) মাসিকের রক্তক্ষরণের সময়কালে প্রতি ৫-৬ ঘন্টা পরপর স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন করুন। অধিক রক্তপ্রবাহের ক্ষেত্রে ৩-৪ ঘন্টা পরপর পরিবর্তন করুন।
৫) যৌনাঙ্গ সবসময় পরিষ্কার রাখুন। স্নান করার সময়, প্রতিবার মূত্রত্যাগের পর এবং সহবাসের পর জল দিয়ে ভালো করে যৌনাঙ্গ ধুয়ে নিন। এটি অভ্যাসে পরিণত করুন।
৬) যৌনাঙ্গ ধোয়ার সময় যোনিপথে সাবান ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। এতে যোনিপথের pH-এর মান পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভবনা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যৌনাঙ্গে সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৭) যৌনাঙ্গ মোছার সঠিক উপায় জেনে নিন। ল্যাট্রিন বা টয়লেটের পর যৌনাঙ্গটি সবসময় সামনের থেকে পিছনের দিকে পরিষ্কার করুন। উল্টো দিকে অর্থাৎ পিছন থেকে সামনের দিকে নয়। যৌনাঙ্গ ধোয়ার সুযোগ না থাকলে প্রতিবার প্রস্রাবের পরে শুকনো নরম কাপড় বা টয়লেট পেপার দিয়ে যৌনাঙ্গ মুছুন।
৮) নিরাপদ যৌন জীবনযাপন করুন। যৌনক্রিয়ার সময় কোনো তৈলাক্তকর পদার্থ ব্যবহার করবেন না। একাধিক যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকুন।
৯) যৌনাঙ্গের চুল শেভ করবেন না। এটি রোগ জীবাণু প্রবেশের হাত থেকে যৌনাঙ্গকে রক্ষা করে।
১০) বেশি করে জল খান। ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদিও বেশি খান।
১১) সারা রাত এক গ্লাস জলে এলাচ ভিজিয়ে সেই জল সকালে খালি পেটে খান। জলে পেয়ারা পাতা সেদ্ধ করে, সেই জল খেতে পারেন। ঢেঁড়স সেদ্ধ করে খেলে, সাদাস্রাবের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। ঢেঁড়স সেদ্ধর সঙ্গে টক দই মিশিয়ে নিতে পারেন।
১২) টাটকা টক দই খান। টক দই আপনার খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করার সঙ্গে সঙ্গে, এতে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড সাদাস্রাব নিঃসরণ কমাতেও সাহায্য করে।
১৩) মধু ও তুলসী পাতা খান। সেই সঙ্গে নিয়মিত কলা, নাসপাতি, বেদানা, পেয়ারা, আমলকি ইত্যাদি ফল খান। মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার খান।
১৪) সাদাস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ভাতের মার খেতে পারেন। ক্রমাগত সাদাস্রাবের সমস্যায় ভুগলে আপনার জন্য ভাতের মাড় একটি অনন্য প্রতিকার।
১৫) নিয়মিত যোগব্যায়াম, ধ্যান বা মনঃসংযোগ অভ্যাস করুন। সকালে হাঁটতে বের হোন। এতে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কম থাকবে। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
সাদাস্রাব হল এমন একটি সমস্যা, যাতে ভয় নেই অথচ আছে এইরকম ব্যাপার! সাধারণ সাদাস্রাবে সত্যিই কোনো ভয় নেই। তবে দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাভাবিক অতিরিক্ত সাদাস্রাবের ক্ষেত্রে ভয়ের কারণ থেকেই যায়। তাই প্রথমেই সাবধান হওয়া, সর্বোপরি এই নিয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
আরও পড়ুন :
(১) পিরিয়ড বা মাসিক কী? কেন হয়? জেনে নিন খুঁটিনাটি সবকিছু।
(২) মাসিকের ব্যাথা বা Dysmenorrhea কমানোর জন্য কী করণীয়?
(৩) মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা - শিশুর জন্য মাতৃদুগ্ধই সর্বোত্তম।
(৪) গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস? জেনে নিন, কারণ, ঝুঁকি ও চিকিৎসা।
(৫) বগলের কালো দাগ দূর করার উপায়।