You are currently viewing পিরিয়ড বা মাসিক কী? কেন হয়? জেনে নিন খুঁটিনাটি সবকিছু।
মাসিক বা পিরিয়ড কী? কেন হয়? জেনে নিন খুঁটিনাটি সব কিছু।

পিরিয়ড বা মাসিক কী? কেন হয়? জেনে নিন খুঁটিনাটি সবকিছু।

ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

মাসিক চক্র বা রজঃচক্র একটি বিশেষ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা সাধারণত ১০ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক নারীদের দেহে নিয়মিত ঘটে থাকে। এই চক্রাকার প্রক্রিয়া স্ত্রী জননতন্ত্রে ঘটে এবং এতে জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের গঠনের চক্রাকার পরিবর্তন সাধিত হয়। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন নামক স্ত্রী হরমোন এই প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। নারীদেহে মাসিক চক্র সম্পন্ন হয় বলেই নারীরা সন্তান ধারণ করতে পারেন। মানুষ ছাড়াও আরও কিছু প্রাইমেটদের মধ্যে রজঃচক্র লক্ষ্য করা যায়।

মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায় :

মাসিক চক্র নির্ভর করে হাইপোথ্যালমিক ফ্যাক্টরস এবং পিটুইটারি গ্রন্থি ও ডিম্বাশয় নিঃসৃত কয়েকটি হরমোনের সূক্ষ্ম ব্যালেন্সের ওপর। ২৮ দিনের এই চক্রের পর্যায়গুলিকে চারটি প্রধান ধাপে ভাগ করা হয়েছে।

  1. ফলিকিউলার দশা (Follicular phase)
  2. ডিম্বাণু নিঃসরণ দশা (Ovulation phase)
  3. লিউটিয়াল দশা (Luteal phase)
  4. মেনস্ট্রুয়েশন দশা (Menstruation phase)

১. ফলিকিউলার দশা(Follicular phase):

মাসিকের প্রথম দিন থেকে ১৪তম দিন অর্থাৎ ডিম্বাণু নিঃসরণ হ‌ওয়া অবধি এই দশার সময়কাল। এই দশায় পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন(FSH) এর প্রভাবে ডিম্বাশয়ে ৫-২০টি ছোট ছোট ফলিকল গঠিত হয়। এই ফলিকলের মধ্যে থাকে অপরিণত ডিম্বাণু। এদের মধ্যে একটি ফলিকল পরিণত হয়ে গ্রাফিয়ান ফলিকল গঠন করে এবং এতে পরিণত ডিম্বাণু অবস্থান করে। এই সময়ই ডিম্বাশয় থেকে অধিক পরিমাণে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরিত হয় এবং ১২তম দিনে এর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি হয়। এই দশার শেষের দিকে জরায়ুগাত্র পুরু এবং বেশি বেশি রক্তজালকপূর্ণ হতে শুরু করে।

২. ডিম্বাণু নিঃসরণ দশা (Ovulation):

ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH)-এর প্রভাবে পরিণত গ্রাফিয়ান ফলিকল এত বড় হয়ে যায় যে এর ত্বক অনেক পাতলা হয়ে যায়। পিটুইটারি নিঃসৃত লিউটিনাইজিং হরমোন (LH) এর প্রভাবে এটি ফেটে গিয়ে ডিম্বাণু নির্গত হয়। ডিম্বাণু নিঃসরণ হওয়ার ঘটনাকেই বলা হয় ওভিউলেশন। সাধারণত মাসিক চক্রের ১৪ তম দিনে অর্থাৎ ঠিক মাঝামাঝি পর্যায়ে ওভিউলেশন ঘটে। এই সময় দেহের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পায়। নির্গত ডিম্বাণুটি ফ্যালোপিয়ান টিউবে অবস্থান করে এবং যৌনমিলন কালে এই টিউবেই এটি নিষিক্ত হয়।

বিঃ দ্রঃ – একমাত্র ওভিউলেশন দশাতেই ডিম্বানু শুক্রানু দ্বারা নিষিক্ত হলে গর্ভাবস্থা সৃষ্টি হয়। ২৪ ঘন্টা এই দশা স্থায়ী হয়। নিষিক্ত না হলে এরপর ডিম্বাণুটি মারা যায় বা দ্রবীভূত হয়ে যায়।

৩. লিউটিয়াল দশা (Luteal phase) :

এই দশার সময়কাল সাধারণত ১৫ তম দিন থেকে ২৮ তম দিন। ওভিউলেশনের পর খালি ফলিকলটি পরিণত হয় করপাস লিউটিয়ামে। এই করপাস লিউটিয়াম থেকে বেশি পরিমাণ প্রোজেস্টেরন এবং অল্প ইস্ট্রোজেন নির্গত হতে থাকে। এর ফলে নতুন ফলিকল তৈরিতে বাধা পায়। জরায়ুগাত্র পুরু হতে থাকে এবং ভ্রুণ ধারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ডিম্বাণু নিষিক্ত হলে জরায়ু গাত্রে ভ্রূণ রোপণের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং প্রোজেস্টেরন সহ আরো কয়েকটি হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। এরকম একটি হরমোন হল হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (HCG) যেটি গর্ভবতী মহিলার মূত্রে পাওয়া যায় এবং ইউরিন টেস্টে এই হরমোনটির উপস্থিতি দেখেই গর্ভাবস্থা প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা হয়

৪. মেনস্ট্রুয়েশন দশা (Menstruation phase) :

ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে অর্থাৎ গর্ভাবস্থা সৃষ্টি না হলে এই দশা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত এই দশা ৩-৫ দিন স্থায়ী হয়। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা অনেক কমে যায় এবং কর্পাস লিউটিয়াম সংকুচিত হয়ে যায়। অনিষিক্ত ডিম্বানু, জরায়ুগাত্রের পুরু কোশস্তর, মিউকাস ইত্যাদি রক্তক্ষরণের মাধ্যমে যোনিপথ দিয়ে নির্গত হয়, যাকে সাধারণ ভাষায় মাসিক বা পিরিয়ড (Period) বলা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাসিক চক্রের প্রথম ও চতুর্থ সপ্তাহকে(১ থেকে ৭দিন এবং ২১ থেকে ২৮ দিন) নিরাপদ সময় হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ এই সময় যৌনমিলন ঘটলে গর্ভধারণ সাধারণত হয় না। মাসিক চক্রের মাঝের দু সপ্তাহকে(অর্থাৎ ৮ থেকে ২০ দিন) উর্বর সময় ধরা হয়। এই সময় যৌনমিলন হলে গর্ভাবস্থা সৃষ্টি হয়।

পিরিয়ড বা মাসিকের সময় বেশ কিছু উপসর্গ থাকতে পারে যেগুলো অল্প মাত্রায় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যেমন–

  • তলপেটে ব্যথা,
  • হাত-পায়ের পেশীতে ব্যথা,
  • স্তনে ব্যথা বা ভারী বোধ হ‌ওয়া,
  • দুর্বলতা,
  • মুড সুইং বা মেজাজ ভালো না থাকা ইত্যাদি।

মাসিক চলাকালীন কিছু করণীয়

১) অবশ্যই পরিছন্নতা মেনে চলা। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা। কিংবা কাপড় ব্যবহার করলে সেটা সাবান জলে কেচে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে এবং দীর্ঘদিন একই কাপড় ব্যবহার করা যাবে না।


২) তলপেটে ব্যথার ক্ষেত্রে হট ব্যাগ ব্যবহার বা গরম সেঁক নিলে উপকার পাওয়া যায়।


৩) এই সময় হালকা গরম জলে স্নান করা ভালো।


৪) ভারী জিনিস তোলা এবং অধিক পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকা।


৫) আয়রন সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।


৬) পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি।

কোন ক্ষেত্রে মাসিক হয় না?

  • স্বাভাবিক অবস্থায়,গর্ভাবস্থা সৃষ্টি হলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় এবং বাচ্চা জন্মের বেশ কিছুদিন পর পুনরায় এটি শুরু হয়।
  • স্তন্যদানরত মায়েদের শরীরে প্রোল্যাকটিন হরমোনের আধিক্যের কারণে মাসিক বন্ধ থাকে বা কম মাত্রায় অনিয়মিত হয়।
  • এছাড়াও ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়স্ক মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হতে থাকে। এক সময় একবারে বন্ধ হয়ে যায়, যাকে বলে মেনোপজ। এই অবস্থাগুলি খুব স্বাভাবিক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আরও পড়ুন –
(১) গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস? উপেক্ষা নয়, জানুন কী করণীয়।
(২) নাক ডাকার সমস্যা? জেনে নিন কারণ ও সমাধান।
(৩) মাসিকের ব্যথা কমানোর জন্য কী করণীয়?

মাসিক (Period) সংক্রান্ত কিছু অস্বাভাবিকতা

১) অনিয়মিত মাসিক :

দুই-তিন মাস অন্তর মাসিক হ‌ওয়া কিংবা নির্দিষ্ট দিনের অনেকদিন আগে বা পরে মাসিক হ‌ওয়াকে অনিয়মিত মাসিক বলা হয়। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন – অপুষ্টি, হঠাৎ অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস, অত্যধিক মানসিক চাপ, থাইরয়েড হরমোনের গন্ডগোল জনিত অসুখ হা‌ইপারথাইরয়েডিজম বা হাইপোথাইরয়েডিজম, ওভারিয়ান সিস্ট, পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) ইত্যাদি।

২) অত্যধিক রক্তক্ষরণ :

মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাওয়া মাসিকের অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করে। জরায়ুতে টিউমার বা পলিপ সৃষ্টি, হরমোন সংক্রান্ত সমস্যা বা রক্তক্ষরণ সম্পর্কিত কোনো অসুখ এর কারণ হতে পারে।

৩) মাসিকের দীর্ঘসূত্রিতা :

৭ দিনের বেশি মাসিক চলতে থাকা,অধিক রক্তক্ষরণ, এক মাসে দুবার মাসিক হ‌ওয়া ইত্যাদি স্বাভাবিক নয়। জরায়ুর টিউমার, হরমোনের সমস্যার কারণে এটি হতে পারে।

৪) স্বল্প মাসিক :

এক বা দু’দিন মাসিক স্থায়ী হওয়া, খুব অল্প পরিমাণ রক্তক্ষরণ মাসিকের অস্বাভাবিকতা বোঝায়। অপুষ্টি, কম ওজন, থাইরয়েড হরমোনের গন্ডগোল বা পলিসিসটিক ওভারি এর কারণ হতে পারে।

৫) তলপেটে অসহ্য ব্যথা:

মাসিকের সময় তলপেটে অল্প ব্যথা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তবে অসহ্য যন্ত্রণা এবং এর ফলে শয্যাশায়ী অবস্থা স্বাভাবিক নয়।

উল্লেখিত এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরী।

মাসিক (Period) নিয়ে কিছু মিথ বা কুসংস্কার

মাসিক নিয়ে বহু কুসংস্কার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। বর্তমান সময়ে যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যেমন –

  • মাসিককে অলৌকিক বা অপ্রাকৃতিক ভাবা।
  • মাসিক চলাকালীন মেয়েদের অশুচি ভাবা এবং তাদের পূজাস্থলে বা মন্দিরে ঢুকতে না দেয়া।
  • রান্নাঘর বা গোয়াল ঘরে ঢুকতে বারণ করা।
  • এই সময় মেয়েদের তুলসী, পান ইত্যাদি গাছের কাছে যেতে বারণ করা।
  • গ্রামাঞ্চলে মাসিক চলাকালীন মেয়েদের কৃষি জমির পাশ দিয়েও যেতে বারণ করা হয়, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।

বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে আমরা জানি, মাসিক একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় ঘটনা। এটি কোনো অলৌকিক বা অশুভ শক্তির প্রভাবে ঘটে না। তাই মাসিক চলাকালীন মেয়েদের অশুচি না ভেবে তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। এই সময় মেয়েরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করলে সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে।

মাসিক বা পিরিয়ড সম্পর্কিত বিভিন্ন ভুল ধারণা ভেঙে এই সম্পর্কে স্বাস্থ্য-সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ মে World Menstrual Hygiene Day হিসাবে পালন করা হয়। মাসিক চলাকালীন হাইজিন মেনে না চলার জন্য বহু মা-বোনদের নানান শারীরিক জটিলতার শিকার হতে হয়। এমন কি নানান অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রতিটি মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি পুরুষেরও উচিত এই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি নিয়ে সচেতন হওয়া। এটাকে স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসাবে গ্রহণ করা।

সায়নী মন্ডল


ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

This Post Has 6 Comments

মন্তব্য করুন