মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার কারণ বিভিন্ন হতে পারে। এর পিছনে থাকতে পারে বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যা। তাই অবহেলা না করে, প্রথমেই সাবধান হন।
আমাদের স্বাভাবিক সচেতনতার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ দায়ী। আর মস্তিষ্কের কাজকর্ম সঠিকভাবে করার জন্য দরকার হয় রক্তের। রক্তের গ্লুকোজ ও অক্সিজেন মস্তিষ্কে পৌঁছে কোষের পুষ্টি জোগায়। আর সেই পুষ্টি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে কাজ করে মস্তিষ্ক। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সমস্যা সৃষ্টি হয় কোনও কারণে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল সামান্য ব্যাহত হলে। তখনই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, মস্তিষ্কের ভার্টিগো ভেসিলারি নামের এক ধমনিতে রক্ত কম পৌঁছালেই মাথা ঘোরে। মেডিকেল পরিভাষায় এর নাম সিনকোপি।
মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া একটি লক্ষণ মাত্র। এটা কোনও রোগ নয়। শারীরিক নানান জটিলতার কারণে এমন হতে পারে –
Table of Contents
মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ
(১) হৃৎপিণ্ডজনিত কারণে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সমস্যা হয়
আমাদের শরীরের প্রতিটি প্রান্তে রক্তকে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব থাকে হৃৎপিণ্ডের ওপর। তাই হৃৎপিণ্ডের কোনও সমস্যা হলে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এইরকম সমস্যার পিছনে থাকতে পারে
- অ্যারিদমিয়া (Arrhythmia) – হৃদপিণ্ডের গতির ছন্দপতন।
- ব্র্যাডি কার্ডিয়া (Bradycardia) – হৃদগতি কমে যাওয়া।
- আর্টারি ব্লকেজ (Artery Blockage) – হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে প্লাক জমে এই সমস্যা হয়। ধমনিতে রক্তের গতিপথে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ জমে তৈরি হয় প্লাক। বাধা পায় রক্তের স্বাভাবিক চলাচল।
- কার্ডিও মায়োপ্যাথি (Cardiomyopathy) – ভাইরাল ইনফেকশনের জন্য হৃৎপিণ্ডের পেশিগুলি রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
- পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন (Pericardial Iffusion) – হৃৎপিণ্ডে তরল জমে।
- হার্ট ফেলিওর।
- হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।
আরও পড়ুন :
(১) হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ
(২) উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা
(৩) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
(৪) কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখবেন কীভাবে?
(৫) নাক ডাকার কারণ ও সমাধান
(২) এপিলেপসি (Epilepsy) বা মৃর্গী রোগের কারণে মাথা ঘোরা
এপিলেপসি বা মৃগী মস্তিষ্কের স্নায়ু গঠিত একটি সমস্যা। এই রোগের কারণেও মাথা ঘোরার সমস্যা সৃষ্টি হয়।
(৩) নিম্ন রক্তচাপও মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার কারণ
কোনও কারণে রক্তচাপ স্বাভাবিকের (120/80 mmHg) থেকে অনেক কম হলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছাতে পারে না। সেক্ষেত্রেও মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার এই সমস্যা হতে পারে।
(৪) মস্তিষ্কে টিউমার
মস্তিষ্কে টিউমার হলেও মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। তখন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
(৫) চোখের রক্তচাপ কমে যাওয়া
চোখের ভিতরে রক্তের স্বাভাবিক চাপ হল ১৮ মিলিলিটার অব মার্কারি। তবে কোনও কারণে চোখের ভিতরে রক্তের চাপ কমে গেলে হঠাৎ মাথা ঘোরে।
(৬) কানের সমস্যার কারণেও মাথা ঘোরে
আমাদের অন্তকর্ণের ভেস্টিবুলার সিস্টেম দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাই কানের সমস্যা হলেও মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
(৭) হঠাৎ মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার অন্যতম কারণ স্ট্রোক
ইসকেমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক, এই দু’ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেই মানুষ সাধারণত মাথা ঘুরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।
(৮) রক্তক্ষরণের কারণে মাথা ঘোরা
দুর্ঘটনা বা অন্যান্য অনেক কারণেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্ত বেরিয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে স্বাভাবিক পরিমাণ রক্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে অনেকে মাথা ঘুরে পড়ে যান।
(৯) রেনাল ডিজঅর্ডার
কিডনির সমস্যায় রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার রক্তে পটাশিয়াম বেড়ে যাওয়ার কারণে হৃদগতি কমে গিয়ে (Bradycardia) মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
(১০) মাথা ঘোরার আর একটি কারণ ‘সুগার ফল’ বা রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া
অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে হঠাৎ করে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। সেক্ষেত্রে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
(১১) পশ্চারাল সিনকোপি (Postural Syncope)
দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যও মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। সেক্ষেত্রেও মাথা ঘোরার সমস্যা হয়।
আরও পড়ুন :
(১) নিয়মিত সাইকেল চালানোর উপকারিতা
(২) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু কার্যকরী উপায়
(৩) বগলের কালো দাগ দূর করবেন কীভাবে?
এছাড়াও রক্ত দেওয়ার সময়, চোখের সামনে রক্ত দেখে (ভেসোফেজাল অ্যাটাক), কাশতে কাশতে, শারীরিক দুর্বলতার কারণে, মূত্রত্যাগের সময়, অত্যধিক ভিড়ের চাপে, রক্ত পায়খানা এবং বিভিন্ন ওষুধের কারণেও (আলফা ব্লকার ইত্যাদি) হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাছাড়া অত্যধিক দুঃশ্চিন্তা (অ্যাংজাইটি), উত্তেজনা, শোক ইত্যাদির কারণেও মাথা ঘোরার সমস্যা হতে পারে।
মাথা ঘোরার সমস্যায় কী করবেন?
সাধারণত সমস্যার লক্ষণ আগে থেকেই প্রকাশ পায়। মাথা ঘুরে পরে পড়ে যাওয়ার আগে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন- বমিবমি ভাব, চোখের মণি ঘোরা, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া বা অন্ধকার দেখা (ব্ল্যাক আউট), ঘন ঘন হাই ওঠা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকা সম্ভব। তাই এমন লক্ষণ দেখা দিলেই বসে পড়া বা শুয়ে পড়া ভালো। পারলে পা দুটো বালিশের উপরে চাপিয়ে উঁচু করে তুলে রাখুন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পরবর্তী পর্যায় হল সংজ্ঞাহীন হওয়া। রোগের চরিত্র এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে অজ্ঞান হওয়ার সময়কাল। রোগের তীব্রতা যত বেশি, অজ্ঞান হয়ে থাকার সময়কালও থাকে তত বেশি।
কেন মাথা ঘুরছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা খুবই জরুরি। তাই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি। ইসিজি, ইইজি, হল্টার মনিটরিং, মাথার সিটি স্ক্যান ইত্যাদি টেস্টগুলি চিকিৎসক করাতে দিতে পারেন। পাশাপাশি রোগীর পূর্ববর্তী রোগের ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে, সমস্যা সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করেন চিকিৎসক। রোগ নির্ণয় পর্ব শেষ হলে রোগ ধরে চিকিৎসা চালালেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সেই সঙ্গে নিজের শরীর নিয়ে সচেতন হন। জীবনযাত্রা পাল্টান। খাবারে বেশি নুন, মশলা, তেল যুক্ত খাবার, জাঙ্ক ফুড খাওয়া চলবে না। অতিরিক্ত ভাত খাওয়া এড়িয়ে চলুন। বদলে খান মরশুমি শাক, সবজি, ফল। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। সিগারেট, মদ্যপান বাদ দিন। অত্যাবশ্যক না হলে রাত জাগা চলবে না। পর্যাপ্ত, অন্তত ৭ ঘণ্টা ঘুমোন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হার্টের অন্যান্য অসুখ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা করুন।