পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা অনেক। আপেলের তুলনায় পেয়ারার পুষ্টিগুণ অনেকাংশেই বেশি। “An apple a day keeps the doctor away” বহুল প্রচলিত এই শব্দবন্ধে অনায়াসেই আপেলের পরিবর্তে পেয়ারার উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ পেয়ারায় থাকে ভরপুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, লাইকোপিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য উপাদান। তাছাড়া পেয়ারায় কম ক্যালোরি ও বেশি ফাইবার থাকায় ডায়েটের জন্যও খুব ভালো।
Table of Contents
পেয়ারার পুষ্টিগুণ
পেয়ারার পুষ্টিগুণ বা পুষ্টিমূল্য এতটাই বেশি যে অনেকে একে সুপারফুড হিসাবে বিবেচনা করেন। একটি ১০০ গ্রাম ওজনের পেয়ারায় কী কী থাকে, তা নীচে উল্লেখ করা হল –
শক্তি | ৬৮ ক্যালোরি |
ফ্যাট | ১ গ্রাম |
মোট শর্করা | ১৪.৩২ গ্রাম |
(ক) ডায়েটারি ফাইবার | ৫.৪ গ্রাম |
(খ) সুগার | ৮.৯২ গ্রাম |
প্রোটিন | ২.৬ গ্রাম |
জল | ৮০.৮ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ১৮ মিলিগ্রাম |
আয়রন | ০.২৬ মিলিগ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | ২২ মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | ৪০ মিলিগ্রাম |
জিঙ্ক | ০.২৩ মিলিগ্রাম |
কপার | ০.২৩ মিলিগ্রাম |
সোডিয়াম | ২ মিলিগ্রাম |
পটাশিয়াম | ৪১৭ মিলিগ্রাম |
লাইকোপিন | ৫২০০ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন A* | ১২% |
ভিটামিন C* | ৩৮১% |
**সূত্র – USDA
উল্লেখিত পুষ্টি-উপাদানগুলি ছাড়াও পেয়ারায় আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বর্তমান থাকে। ভিটামিন A ও ভিটামিন C ছাড়াও ভিটামিন B-কমপ্লেক্স ও ভিটামিন K অল্প পরিমাণে থাকে।
পেয়ারা খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা
পেয়ারা ডায়াবেটিস তথা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
পেয়ারায় ডায়েটারি ফাইবার বেশি থাকায় এবং পেয়ারার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি ডায়াবেটিস রুগীদের জন্য খুবই উপযোগী। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায় না। আবার পেয়ারার ডায়েটারি ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। তাই ডায়াবেটিস রোগী ও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা যাঁদের আছে তাঁদের জন্য পেয়ারা একটি উত্তম ফল।
আপনার হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য পেয়ারা খাওয়া অত্যন্ত উপকারি
পেয়ারায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সোডিয়াম ও পটাসিয়াম থাকে। তাই পেয়ারা খাওয়ার ফলে দেহে সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের ভারসাম্য ঠিক থাকে। এটি হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের রুগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাছাড়া পাকা পেয়ারা খাওয়ার ফলে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা কমে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) এর মাত্রা বাড়ে। ফলে আমাদের হার্ট বা হৃৎপিন্ড ভালো থাকে। তাই হার্টের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পেয়ারা খাওয়া অত্যন্ত উপকারি।
★ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখবেন কীভাবে?
★ উচ্চ রক্তচাপের কারণগুলি কী কী?
★ উচ্চ রক্তচাপ লক্ষণ ও উচ্চ রক্তচাপজনিত কী কী সমস্যা হতে পারে?
★ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো কী কী?
পেয়ারা খাওয়ার ফলে পায়খানা পরিষ্কার হয় তথা কোষ্ঠকাঠিন্যে উপকার পাওয়া যায়
অন্যান্য ফলের তুলনায় পেয়ারায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো ডায়েটারি ফাইবার থাকে। তাই প্রতিদিন একটি করে পেয়ারা খাওয়া পৌষ্টিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। পেয়ারা, বিশেষত পেয়ারার বীজ স্বভাবিক মলত্যাগ করতে সাহায্য করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি কমে।
ওজন কমানোর লক্ষ্যে খাদ্য তালিকায় পেয়ারা রাখুন
আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তবে ফল হিসাবে পেয়ারা খাওয়া খুবই উপকারি। পেয়ারা বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করে। পেয়ারা খাওয়ার ফলে প্রোটিন, ভিটামিন ও ফাইবারের ঘাটতিও হয় না, সেইসঙ্গে দেহের ওজন কমে। পেয়ারা খুব সহজেই ক্ষুধা মেটায়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। যা ওজন বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। তাছাড়া অন্যান্য ফল যেমন আপেল, আঙুর, কমলা, কলা প্রভৃতি ফলের তুলনায় কাঁচা পেয়ারায় কম শর্করা থাকে। স্বভাবতই কাঁচা পেয়ারা খাওয়ার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
★ ওজন বৃদ্ধির কারণগুলি জানেন কী?
★ জেনে নিন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার বেশ কিছু কার্যকরী উপায়।
পেয়ারা ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
আমাদের দেহে ভিটামিন C এর ঘাটতি থাকলে, ইমিউনিটি কমে যায়। বার বার সংক্রমণের শিকার হতে হয়। পেয়ারায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন C বর্তমান থাকে। সমভরের কমলা লেবুর থেকে প্রায় চারগুণ বেশি ভিটামিন C পেয়ারায় থাকে। এই ভিটামিন C আমাদের ইমিউনিটি বৃদ্ধি করতে খুবই কাজে লাগে।
ভিটামিন C খারাপ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সংক্রমণের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। ঠান্ডা লাগার মতো সমস্যায় সহজে উপশম পাওয়া যায়। এছাড়া দেহের আয়রন-শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, আমাদের ইমিউনিটি ও কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
আপনার ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত পেয়ারা খেতে পারেন
আপনি যদি আপনার ত্বকের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন হন, তবে আপনার নিয়মিত পেয়ারা খাওয়া উচিত। ত্বক কুঁচকে যাওয়া, ত্বকের বলিরেখা নিয়ে খুঁতখুঁতে না হয়ে নিয়মিত পেয়ারা খান, দেখবেন উপকার পাবেন। কারণ পেয়ারায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। পেয়ারায় উপস্থিত লাইকোপিন, বিটা-ক্যারোটিন, লুটেইন প্রভৃতি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলি ছাড়াও বিভিন্ন ভিটামিন ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। নিয়মিত পেয়ারা খেলে ত্বকের ডার্ক সার্কেল, ত্বকের লাল দাগ, ব্রণ হওয়া প্রভৃতি সমস্যা এড়ানো যায়। পেয়ারায় থাকা বিভিন্ন উপাদান মুখের ত্বক ও মাংশপেশীকে সতেজ ও সমর্থ রাখতে সাহায্য করে। ফলে ত্বকের যৌবন অক্ষুন্ন থাকে।
★ বগলের কালো দাগ দূর করবেন কীভাবে?
পেয়ারা দৃষ্টিশক্তি উন্নত রাখতে সাহায্য করে
নিয়মিত পেয়ারা খেলে চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত থাকে। পেয়ারায় উপস্থিত ভিটামিন A চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ভিটামিন A চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াই শুধু প্রতিরোধ করে তাই না, সেই সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতেও সাহায্য করে। এটি চোখে ছানি পড়াও প্রতিরোধ করে।
পেয়ারার মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়
পেয়ারায় থাকে লাইকোপিন, কুয়েরসেটিন, ভিটামিন C এবং অন্যান্য পলিফেনল। এগুলি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। বিপকক্রিয়ায় উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন ফ্রি-রেডিক্যালস্ গুলিকে দেহ থেকে বের করে দিতে এগুলি সাহায্য করে। ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা হ্রাস পায়।
বেশ কিছু গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে, নিয়মিত পেয়ারা খাওয়া প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এবং স্তন ক্যান্সার কোশের বৃদ্ধি রোধেও সাহায্য করে।
গর্ভবতী মহিলা ও শিশুর জন্য পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা আছে
পেয়ারায় পর্যাপ্ত ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B9 থাকে। এই ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B9 গর্ভবতী মায়ের গর্ভে থাকা বাচ্চার স্নায়ুতন্ত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাছাড়া নবজাতক শিশুকে স্নায়ুজনিত বিভিন্ন ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। পেয়ারায় থাকা B ভিটামিনগুলি ভ্রূণের DNA ও জেনেটিক বস্তুগুলির গঠনে এবং ভ্রূণের কোশ বিভাজনে সাহায্য করে। তাই গর্ভবতী মহিলা ও শিশুর জন্য পেয়ারা খাওয়া খুবই উপকারি।
★ গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস? জেনে নিন, ঝুঁকি ও সমাধান। ★ সাদাস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার। ★ মাসিকের ব্যথা বা ডিসমেনোরিয়া কমানোর জন্য কী করবেন?
ক্লান্তি দূর করতে ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পেয়ারা খান
পেয়ারায় থাকে ম্যাগনেসিয়াম। এই ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশি ও স্নায়ুর উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। তাই একটি স্ট্রেসফুল কাজের শেষে, ক্লান্তি দূর করতে পেয়ারা খাওয়া যেতে পারে। এটি মাংশপেশিকে রিল্যাক্স করে ও মানসিক চাপ দূর করে। সেই সঙ্গে সঙ্গে শরীরকে নতুন করে শক্তি প্রদান করে।
ওপরে উল্লেখিত পুষ্টি উপাদানগুলো ছাড়াও পেয়ারায় থাকে ভিটামিন B6 (pyridoxine) ও B3 (niacin)। এই ভিটামিনদুটি মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন উন্নত রাখে, স্নায়ু শিথিল রাখে এবং কগনিটিভ ফাংশনকে উদ্দীপিত করে। অর্থাৎ পেয়ারা খাওয়ার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক তথা মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
আরও একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, পেয়ারার খাওয়ার উপকারিতা যেমন অনেক, ঠিক তেমনি পেয়ারার পাতার উপকারিতাও কম নয়। টাটকা সতেজ পেয়ারা পাতায় থাকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট। ব্যাথা উপশমেও পেয়ারা পাতার রস বিশেষ কার্যকরী। তাছাড়া পেয়ারা পাতার আরও অনেক উপকারিতা আছে, তা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।