You are currently viewing থ্যালাসেমিয়া : সচেতনতাই হাতিয়ার, জেনে নিন লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া : সচেতনতাই হাতিয়ার

থ্যালাসেমিয়া : সচেতনতাই হাতিয়ার, জেনে নিন লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা

ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

থ্যালাসেমিয়া হল উত্তোরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত একটি জিনগত সমস্যা যার ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরি ব্যাহত হয় বা ত্রুটিযুক্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। বাবা-মা’র থেকে এই রোগ বাচ্চার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। হিমোগ্লোবিন হল লোহিত রক্তকণিকার এমন একটি উপাদান যা রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায়।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতির কারণে লোহিত রক্তকণিকা ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। সহজেই ভেঙে যায়। রক্তপ্রবাহে সুস্থ লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে গিয়ে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা সৃষ্টি হয়। দেহের প্রতিটি কলা-কোশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছানোর ফলে দুর্বলতা ও বিভিন্ন রকম অসুস্থতা দেখা যায়।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর মৃদু থেকে তীব্র অ্যানিমিয়া হতে পারে। তীব্র বা গুরুতর অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে দেহের বিভিন্ন তন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীর ক্ষেত্রেই রক্ত সঞ্চালনের (Blood Transfusion) প্রয়োজন হয়।

সারা বিশ্বে প্রতিবছর বহু সংখ্যক শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। বাবা-মায়ের জিন থেকেই যেহেতু এই রোগ সঞ্চারিত হয়, তাই সামান্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই এই রোগকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়।

প্রতিবছর ৮ই মে থ্যালাসেমিয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, তাঁদের মানসিক সাহস যোগানো ও জনসাধারণের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর লক্ষণ

থ্যালাসেমিয়া রোগের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। সেই প্রকারভেদ অনুযায়ী এই রোগের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যে কিছু বিভিন্নতা দেখা যায়। তবে বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য সব ধরণের থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রেই দেখা যায় –

  • অত্যধিক ক্লান্তি
  • শারীরিক দুর্বলতা
  • অন্যদের তুলনায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি এবং ধীর মানসিক বিকাশ
  • ফ্যাকাশে বা হলুদাভ ত্বক
  • হাড়ের ত্রুটিপূর্ণ গঠন বা হাড়ের বিকৃতি (বিশেষত মুখমণ্ডলে)
  • পেট ফুলে যাওয়া
  • হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি বা রক্তাল্পতা
  • অপরিষ্কার গাঢ় রঙের বা কালো রঙের মূত্র ইত্যাদি।

কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে জন্মের পরে পরেই এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। আবার অনেকক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হয়।

তবে শুধু মাত্র থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার বা বাহক (Carrier/Trait) হলে কোনো সমস্যাই দেখা যায় না। শুধুমাত্র মৃদু রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সমস্যা থাকতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়

থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই দেখা যায়। শিশুর দেহে রক্তাল্পতাসহ ওপরে উল্লেখিত লক্ষনগুলির এক বা একাধিক যখন পরিলক্ষিত হয়, তখন চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

  • Complete Blood Count (CBC) টেস্টের মাধ্যমে রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা তথা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ এবং আকার দেখা হয়। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্তে সুস্থ ও স্বাভাবিক লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা কম থাকে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় কম হিমোগ্লোবিন থাকে। আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের দেহে স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় ছোট আকারের লোহিত রক্তকণিকা থাকে।
  • রেটিকিউলোসাইট কাউন্ট টেস্টের মাধ্যমে রক্তে তরুণ লোহিত রক্তকণিকা পরিমান দেখা হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় রোগীর বোন ম্যারো ঠিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন করছে কি না।
  • বিটা থ্যালাসেমিয়া শনাক্তকরণের জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস টেস্ট করা হয়। আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া শনাক্তকরণের জন্য জেনেটিক টেস্টও করা হয়ে থাকে।
  • আয়রন প্রোফাইল টেস্টের মাধ্যমে দেখা হয়, রোগটি থ্যালাসেমিয়াজনিত রক্তাল্পতা না কি সাধারণ রক্তাল্পতা।

থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ

যে কোনো সাধারণ মানুষের শরীরে ৪৬ টি ক্রোমোজোম থাকে। ২৩ টি ক্রোমোজোম বাবার শরীর থেকে এবং ২৩ টি ক্রোমোজোম মায়ের শরীর থেকে আসে। থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রোগ হওয়ায়, একমাত্র বাবা-মায়ের থেকেই সন্তানের দেহে এই রোগ সঞ্চারিত হতে হয়। বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া (মেজর) হওয়ার সম্ভবনা প্রবল থাকে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সন্তান সাধারণত স্বাভাবিক বা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (বাহক) হয়।

বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তান কেমন হবে?
বাবা ও মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তান কেমন হবে?

থ্যালাসেমিয়া DNA-এর মিউটেশনজনিত একটি রোগ যার ফলে হিমোগ্লোবিন তৈরি ব্যাহত হয়। এই হিমোগ্লোবিন অনু আলফা ও বিটা নামের দুটি শৃঙ্খল দ্বারা গঠিত। থ্যালাসেমিয়া রোগে এই আলফা ও বিটা শৃঙ্খলদুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে।

আলফা থ্যালাসেমিয়া

আলফা থ্যালাসেমিয়া কতটা তীব্র হবে, তা নির্ভর করে বাবা-মায়ের থেকে ক’টি ত্রুটিপূর্ণ বা মিউটেটেড জিন সন্তান পেয়েছে তার ওপর। আলফা হিমোগ্লোবিন শৃঙ্খল তৈরি করতে চারটি জিন মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই চারটি জিনের মধ্যে দুটি বাবার থেকে এবং দুটি মায়ের থেকে সন্তানের দেহে সঞ্চারিত হয়ে থাকে। সন্তানের দেহে মিউটেটেড জিনের সংখ্যা যত বেশি হবে, থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা তত বেশি হবে।

  • সন্তানের দেহে যদি একটি মাত্র মিউটেটেড জিন থাকে, তবে সন্তানের দেহে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য থাকবে না। তবে সে থ্যালাসেমিয়া বাহক বা কেরিয়ার হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মে তা সঞ্চারিত হবে।
  • সন্তানের দেহে যদি দুটি মিউটেটেড জিন থাকে, তবে সাধারণত সন্তানের মৃদু থ্যালাসেমিয়া দেখা যায়।
  • সন্তানের দেহে যদি তিনটি মিউটেটেড জিন থাকে, তবে সন্তানের দেহে থ্যালাসেমিয়া রোগের বৈশিষ্ট্যগুলি মাঝারি থেকে তীব্র ভাবে লক্ষ্য করা যায়।
  • সন্তানের দেহে উপস্থিত উল্লেখিত চারটি জিন-ই মিউটেটেড হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম, বিরল বলা যায়। সেক্ষেত্রে অপত্য সন্তান সাধারণত ভ্রূণ অবস্থাতেই মারা যায়, বা মৃত সন্তান প্রসব হয়। চারটি মিউটেটেড জিনযুক্ত যে সমস্ত সন্তান জীবিত থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে আজীবন রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন থাকে।

বিটা থ্যালাসেমিয়া

বিটা থ্যালাসেমিয়া সৃষ্টি হয়, বিটা হিমোগ্লোবিন শৃঙ্খলে ত্রুটির কারণে। এই বিটা হিমোগ্লোবিন শৃঙ্খল তৈরি করতে মূলত দুটি জিন মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এই দুটি জিনের একটি বাবার শরীর থেকে এবং অন্যটি মায়ের শরীর থেকে সন্তানের দেহে সঞ্চারিত হয়।

  • সন্তানের দেহে শুধুমাত্র একটি মিউটেটেড জিন সঞ্চারিত হলে, সাধারণত মৃদু উপসর্গযুক্ত থ্যালাসেমিয়ার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বিটা থ্যালাসেমিয়া বলা হয়।
  • সন্তানের দেহে দুটি মিউটেটেড জিন-ই সঞ্চারিত হলে মাঝারি থেকে তীব্র উপসর্গযুক্ত থ্যালাসেমিয়ার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা কুলি রক্তাল্পতা (Cooley Anemia) বলা হয়ে থাকে।

ত্রুটিপূর্ণ দুটি বিটা হিমোগ্লোবিন জিনযুক্ত বাচ্চারা সাধারণত সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবেই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু জন্মের দু’বছরের মধ্যেই থ্যালাসেমিয়ার বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলি প্রকট হতে থাকে।

থ্যালাসেমিয়া জনিত জটিলতা

উল্লেখিত লক্ষণগুলি ছাড়াও, মাঝারি থেকে তীব্র থ্যালাসেমিয়ার কারণে বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা রোগীর দেহে লক্ষ্য করা যায়।

দেহে অতিরিক্ত লোহা জমা (Iron Overload)

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে অতিরিক্ত লোহা জমতে দেখা যায়। লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে যাওয়ার কারণে এবং নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের কারণে এই অতিরিক্ত লোহা জমে থাকে। দেহে অতিরিক্ত লোহা জমে থাকার কারণে হৃৎপিন্ড (heart), যকৃত (liver) এবং এন্ডোক্রাইন সিস্টেম (Endocrine system) ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হাড়ের বিকৃতি (Bone Deformities)

থ্যালাসেমিয়ার কারণে বোন ম্যারোর প্রস্থ বাড়তে থাকে। এর ফলে হাড়ের গঠনে ত্রুটি দেখা যায়, বিশেষত মুখমণ্ডল ও মাথার খুলির হাড়ের গঠনে। তাছাড়া হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।

প্লীহা (Spleen) বেড়ে যাওয়া

দেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্লীহা (spleen) একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাছাড়া নষ্ট হয়ে যাওয়া রক্ত কনিকাগুলি ফিল্টার করতেও প্লীহা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। থ্যালাসেমিয়া রোগে লোহিত রক্তকণিকা সাধারণের তুলনায় তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে, প্লীহাকে বেশি কাজ করতে হয়। ফলে এটির আকার ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে প্লীহার আকার বেড়ে যাওয়ার কারণে রোগীর দেহে সঞ্চালিত লোহিত রক্তকণিকার আয়ু কমে যায়। ফলে রক্তাল্পতার সমস্যা আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তাই প্লীহা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে চিকিৎসক অনেক সময় তা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ঘন ঘন সংক্রমণ

থ্যালাসেমিয়া রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ঘন ঘন সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। যে সমস্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্লীহা (Spleen) সার্জারি করে বাদ দিতে, তাঁদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। থ্যালাসেমিয়া রোগীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি।

হৃৎপিন্ডের সমস্যা

অ্যানিমিয়া এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গে লোহা জমার কারণে, থ্যালাসেমিয়া রোগীর হৃৎপিন্ড দুর্বল হয়। ফলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর, আর্থিমিয়াস প্রভৃতি হতে দেখা যায় এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে কাজ করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা বা প্রকারভেদের ওপর নির্ভর করে এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি। যাঁরা শুধুমাত্র থ্যালাসেমিয়ার বাহক তাঁদের সাধারণত কোনো প্রকার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। থ্যালাসেমিয়া রুগীদের ক্ষেত্রে প্রধানত রক্ত সঞ্চালন (Blood Transfusion) করা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে দেহের অতিরিক্ত লোহা বা আয়রন বের করার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

সঠিক সময়ে রক্তের অপ্রতুলতা এবং ঔষধের দাম অত্যাধিক বেশি হওয়ার কারণে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। অধিকাংশ রোগীই কুড়ি বছর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে! আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের কাছে থ্যালাসেমিয়া তাই মৃত্যুর আরেক নাম!

রক্ত সঞ্চালন (Blood Transfusion) :

থ্যালাসেমিয়ার তীব্রতা যত বেশি হয়, রক্তে সুস্থ হিমোগ্লোবিনের পরিমান তত কম হয়। অর্থাৎ রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার প্রভাব তত বেশি হয়। এই অ্যানিমিয়া তথা থ্যালাসেমিয়ার সঙ্গে লড়ার জন্য রক্ত সঞ্চালনের (Blood Transfution) প্রয়োজন হয়। সাধারণত থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রক্ত সঞ্চালন করতে হয়।

থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা থ্যালাসেমিয়া বাহকদের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার তীব্র সমস্যা না থাকায়, রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না।

দেহ থেকে অতিরিক্ত লোহা বের করা বা আয়রন চিলেশন (Iron Chelation) :

বারংবার রক্ত সঞ্চালনের (Blood Transfusion) ফলে থ্যালাসেমিয়া রোগীর দেহে অতিরিক্ত লোহা জমা হতে থাকে। প্রতি ইউনিট রক্তে প্রায় ২০০-২৫০ মিলিগ্রাম লোহা থাকে। বিশেষত হৃৎপিন্ড, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, হাড়ের জয়েন্টসহ বিভিন্ন অঙ্গে এই লোহা জমা হয়। যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। তাই বিশেষ কিছু ওষুধের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত লোহাকে দেহ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিকেই আয়রন চিলেশন (Iron Chelation) বলা হয়।

ভিটামিন বি সাপ্লিমেন্ট :

অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ভিটামিন বি (ফলিক অ্যাসিড নামে পরিচিত) ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। কারণ ফলিক অ্যাসিড সুস্থ লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। তবে অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গেই (রক্ত সঞ্চালন ও আয়রন চিলেশন) এটি দেওয়া হয় থাকে।

বোন ম্যারো ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট (Bone marrow and stem cell transplant) :

বোন ম্যারো ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট হল একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা, যাঁর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু, বোন ম্যারো ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য উপযুক্ত দাতা (Compatible donar) পাওয়া খুব জরুরি। রোগী ও দাতার কোশে একই ধরণের প্রোটিন তথা Human leukocyte antigens (HLA) আছে কি না তা দেখা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রোগীর ভাই-বোনের সঙ্গেই সাদৃশ্য থাকার সম্ভবনা সবথেকে বেশি। তবে এই চিকিৎসা বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

যে সমস্ত বাচ্চার তীব্র থ্যালাসেমিয়া (মেজর) আছে, তাঁদের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের পর সারা জীবন রক্ত সঞ্চালনের আর প্রয়োজন হয় না। বোন ম্যারো ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের পর রোগীর দেহে নতুন করে সুস্থ ও স্বাভাবিক লোহিত রক্ত কণিকা উৎপন্ন শুরু হয়।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস

এমন কোনো ডায়েট নেই, যা থ্যালাসেমিয়া রোগ থেকে মুক্তি দেয়। তবে স্বাস্থ্যকর ও উপযুক্ত খাদ্যগ্রহণ রোগীকে ভালো অনুভব করতে ও জীবনীশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

কম ফ্যাটযুক্ত ও উদ্ভিজ্জ খাদ্যগ্রহণ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সবথেকে উপযুক্ত। তবে লোহা (Iron) বেশি আছে, এমন খাবার খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মাছ-মাংসে প্রচুর পরিমানে লোহা থাকে, তাই এই দুটি খাবার স্বল্প পরিমানে নিয়ম মাফিক খেতে হবে।

টক জাতীয় ফল যেমন কমলালেবু আয়রন শোষণ করতে সাহায্য করে। আবার চা, কফি, দুধ আয়রন শোষণের হার কমিয়ে দেয়। তাই কমলালেবুজাতীয় ফল এড়িয়ে যেতে হবে।

থ্যালাসেমিয়ার কারণে দেহে ফলিক অ্যাসিড তথা ভিটামিন-বি এর ঘাটতি সৃষ্টি হয়। তাই ভিটামিন-বি যুক্ত খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্যগ্রহণে ভিটামিন-বি বা ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা না মিটলে, চিকিৎসক ভিটামিন-বি সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেন।

থ্যালাসেমিয়া রোগীর হাড়ের গঠন ঠিক রাখতে খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন-ডি থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি

রোগটি জিনবাহিত হওয়ায়, থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সচেতনতা। একমাত্র সচেতনতাই এই রোগ নির্মূল করতে সম্ভব। একটি থ্যালাসেমিয়া রোগী সেই পরিবারের সমস্যার কারণ তো বটেই, সেই সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়।

থ্যালাসেমিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে সামাজিক ও সরকারি ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে এই রোগের কারণ সম্পর্কে প্রচার করা হলে, মানুষ নিজে থেকেই যথেষ্ট সচেতন হতে পারে। সচেতনতা প্রসারের থেকে ভালো বিকল্প এই মুহূর্তে আর কিছু নেই।

সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক নির্ণয় করার জন্য, ব্যাপকভাবে স্ক্রিনিং করা দরকার। বাবা-মায়ের শরীর থেকেই এই রোগ সন্তানের দেহে সঞ্চারিত হয়। তাই বাবা-মা থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না নিশ্চিত থাকলে, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

বিয়ের আগে উভয়েরই বেশ কিছু মেডিকেল টেস্ট আবশ্যিক করতে হবে। যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট অন্যতম। প্রয়োজনে এটি বাধ্যতামূলক করার জন্য সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। উভয়েই বাহক নয় নিশ্চিত হলে, এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা একদমই থাকে না। উভয়েই বাহক হলে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিবাহে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।

যদি কোনো কারণে উভয়েই বাহক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে হয়, তবে সন্তানধারণের পর, টেস্ট করে দেখে নিতে হবে অপত্য ভ্রূণ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কি না। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রয়োজনে গর্ভপাত করা যেতে পারে।

মনে রাখবেন, থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হওয়া লজ্জার নয়। যে কেউ এই রোগের বাহক হতেই পারেন। তাই থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিজে সতর্ক থাকলে, অনেক অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যায়। এই রোগ সম্পর্কে নিজে সচেতন হোন এবং অন্যদের মধ্যেও এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করুন।


ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

This Post Has 3 Comments

  1. generic medicine

    Thank you for sharing your thoughts. I really appreciate your efforts and I am waiting for
    your next write ups thank you once again.

মন্তব্য করুন