ডাবের জল খাওয়ার উপকারিতা সম্বন্ধে না জানলেও ডাবের জল আমরা অনেকেই খাই। বিশেষত গরমের দিনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ডাবের জল কিনে খাওয়া অভ্যাস অনেকেরই। গরমের তীব্র দাবদাহের দিনে ডাবের জলকে অমৃতসমান মনে হয়। বাজারচলতি সমস্ত নরম পানীয় বা কোল্ড ড্রিংকসের থেকে ডাবের জলের উপকারিতা অনেক। ডাবের জল খেলে পেট ঠান্ডা থাকবে, পেট-গরমজনিত সমস্যা হবে না, এই ভেবে অনেকে ডাবের জল খান। কিন্তু ডাবের জলের উপকারিতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা অনেকেরই নেই। আজকের আলোচনা ডাবের জল খাওয়ার উপকারিতা সম্বন্ধেই।
Table of Contents
ডাবের জলের পুষ্টিমূল্য বা ডাবের জলের পুষ্টিগুণ :
ডাবের জল খাওয়ার উপকারিতা সম্বন্ধে জানার আগে, জেনে নিন ডাবের জলে কী কী থাকে। কারণ, ডাবের জলে থাকা উপাদানগুলিই আমাদের শরীরের বিভিন্ন উপকারে কাজে লাগে। ডাবের জলে প্রায় ৯৪% জল, সামান্য শর্করা ও খুবই অল্প পরিমাণ ফ্যাট (১ গ্রামেরও কম) থাকে। এক কাপ তথা ২৪০ মিলি ডাবের জল থেকে ৬০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। ডাবের জলে শর্করা এবং ইলেক্ট্রোলাইট আকারে সহজে হজমযোগ্য কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। কম ক্যালোরিযুক্ত, প্রাকৃতিকভাবে চর্বি এবং কোলেস্টেরল মুক্ত হওয়ায় এর পুষ্টিগত গুরুত্ব অপরিসীম।
দেখা গেছে, একটি সাধারণ মাপের ডাবের জলে চারটি কলার চেয়ে বেশি পটাসিয়াম থাকে। পুরুষদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের প্রায় ১২% ও মহিলাদের প্রয়োজনের প্রায় ১৬% পটাশিয়াম পাওয়া যায়। স্পোর্টস ড্রিংকসের তুলনায় ডাবের জলে কম ক্যালোরি, কম সোডিয়াম এবং বেশি পটাসিয়াম রয়েছে। ৩০ মিলি ডাবের জলে প্রায় ৫.৪৫ ক্যালোরি, ১.৩ গ্রাম চিনি, ৬১ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৫ ৪৫ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে। ডাবের জল ভিটামিন C এর খুব ভালো একটি উৎস। এক গ্লাস ডাবের জলে পুরুষদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের প্রায় ২৭% ও মহিলাদের প্রয়োজনের প্রায় ৩২% ভিটামিন C থাকে। তাছাড়াও ডাবের জলে অল্প পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, জিঙ্ক, তামা থাকে।
ডাবের জল পান করার বিভিন্ন উপকারিতা সম্বন্ধে নীচে আলোচনা করা হল –
(১) ডাবের জল হল তাৎক্ষণিক শক্তি বর্ধনকারী পানীয় বা এনার্জি বুস্টার ড্রিংক
ওয়ার্কআউট তথা খেলাধুলা বা শরীরচর্চার আগে ও পরে পানীয় হিসাবে ডাবের জল একটি দুর্দান্ত পছন্দ। এটি বিভিন্ন খনিজ আয়ন, ইলেক্ট্রোলাইট ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর, যা তাৎক্ষণিক ভাবে শক্তি বৃদ্ধি ও পেশির পুষ্টি প্রদানে সাহায্য করে। ক্রিয়াবিদদের দ্রুত শক্তি পুনরুদ্ধার করতে ডাবের জল খুবই কার্যকরী পানীয়। এতে অনেক স্পোর্টস ড্রিঙ্কের চেয়ে বেশি পটাসিয়াম এবং ইলেক্ট্রোলাইট, কম সোডিয়াম এবং কম কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। তাছাড়া ব্যায়ামের সময় ক্লান্তি ও ডিহাইড্রেশন রোধ করতে ডাবের জল পান করা যেতে পারে।
(২) মিষ্টি ঠান্ডা পানীয়ের অন্যতম বিকল্প ডাবের জল
বাজারচলতি মিষ্টি ঠান্ডা পানীয়ের অন্যতম ভালো বিকল্প হল ডাবের জল। অন্যান্য চিনিযুক্ত ঠান্ডা পানীয়ের তুলনায় এতে কম ক্যালোরি থাকে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অন্যতম একটি পছন্দের পানীয় হওয়া উচিত।
(৩) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে
গবেষণায় দেখা গেছে, ডাবের জল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুরের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ডাবের জল খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যাই হোক, ডাবের জলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর মধ্যে থাকে ম্যাগনেসিয়াম। এই ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে দেয়, ফলে প্রি-ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার পরিমান কমে।
আরও পড়ুন :
(১) গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন হয়? কী করবেন?
(২) পিরিয়ড বা মাসিকের ব্যাথা কমানোর জন্য কী করবেন?
(৩) আদা খাওয়ার উপকারিতা কী কী?
(৪) কাঁচা লঙ্কা খাওয়ার উপকারিতাগুলি কী কী?
(৫) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলি কী কী?
(৬) সাদাস্রাব হলে কী করবেন? কারণ ও প্রতিকার।
(৪) ডাবের জল হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো
ডাবের জল হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। হৃদরোগ কমাতে ডাবের জল অত্যন্ত উপকারী হিসাবে দেখা যেতে পারে। ডাবের জলে পটাশিয়াম লেভেল বেশি থাকায়, তা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ডাবের জল ভালো কোলেস্টেরল (high-density lipoprotein)-এর মাত্রা বাড়ায়। অর্থাৎ ডাবের জল পান করলে বিভিন্ন ধরণের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কিছুটা কমে।
(৫) ডাবের জল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে
পটাশিয়াম বেশি থাকায় ডাবের জল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা নিয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, পটাশিয়াম বেশি থাকা এমন খাদ্যগ্রহণে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং তার ফলস্বরূপ কার্ডিও-ভাস্কুলার স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও স্ট্রোক হওয়া আটকাতে পারে।
(৬) ডাবের জল ভালো হজমে সাহায্য করে
ডাবের জলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম থাকে। এটি আমাদের bowel movements বাড়িয়ে দেয়। ফলে পেতে গ্যাস উৎপন্ন হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ও এসিডিটির সম্ভবনা কমে।
(৭) শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে
বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, ইলেক্ট্রোলাইট এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতির কারণে ডাবের জলের বিভিন্ন উপকারিতা লক্ষ্য করা যায়। ডাবের জল হাইড্রেশন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদান করে আমাদের শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। ডাবের জল সুন্দর ত্বকের জন্যও অবদান রাখতে পারে। ডাবের জল ভিটামিন C ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ, এবং স্বাভাবিকভাবেই কোলাজেন সংশ্লেষণকে উদ্দীপিত করতে পারে। ডাবের জলের বিভিন্ন উপাদান শরীরের অভ্যন্তরীণ জ্বালাভাব কমায় ও কোশকে অক্সিডেটিভ ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
(৮) ডাবের জল কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে
কিডনি স্টোন আটকানোর জন্য অন্যতম সেরা উপায় হল, পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করা। এক্ষেত্রে সাধারণ জল উপকারী হলেও গবেষণায় দেখা গেছে, ডাবের জল এক্ষেত্রে আরো বেশি উপকারী। আপনার প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম, অক্সালেট এবং অন্যান্য যৌগ একত্রিত হয়ে স্ফটিক (Crystals) তৈরি করলে কিডনিতে পাথর তৈরি হয়। স্ফটিকগুলি কিডনিতে ছোট পাথর গঠন করে। ২০১৩ সালে কিডনিতে পাথরযুক্ত ইঁদুরের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, ডাবের জল কিডনি ও মূত্রনালির অন্যান্য অংশে পাথর আটকে যেতে বাধা দেয়। আবার ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় গবেষকরা দেখেছেন যে, কিডনিতে পাথর নেই এমন ব্যক্তিদের প্রস্রাবের মধ্যে ডাবের জল পটাসিয়াম, ক্লোরাইড এবং সাইট্রেটের পরিমাণ বাড়ায়। যার অর্থ, ডাবের জল কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।
(৯) ডাবের জল ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে
অতিরিক্ত ক্লান্তি ও অবসাদে যখন কিছুই করতে ইচ্ছে করে না, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, তখন একটা কচি ডাবের জলে হালকা চুমুক আপনাকে সতেজ করে দিতে পারে। আপনার মন ও শরীরকে তৃপ্তি দিয়ে আপনাকে চনমনে করে দিতে ডাবের জলের জুড়ি মেলা ভার! আপনার হ্যাং-ওভার কাটিয়ে আপনাকে আবার সতেজ করে দেয়।