বিভিন্ন তরকারি তৈরীতে বা স্যালাড হিসাবে টমেটোর ব্যবহার প্রতি বাঙালি বাড়িতেই কম-বেশি হয়ে থাকে। টমেটো হল এমন একটি ফল যা আমরা সাধারণত সবজি হিসাবেই গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু টমেটো খাওয়ার বিভিন্ন আশ্চর্যজনক উপকারিতার কথা, এর পুষ্টিমূল্যের কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, টমেটোর আদি উৎপত্তিস্থল হিসাবে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকাকে ধরা হয়। ইউরোপিয়ানরা যখন এই ফল বা সবজিটি প্রথম দেখে, তাঁরা এটিকে বিষাক্ত ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্প্যানিশরা বিশ্বের দরবারে টমেটোকে খাদ্যবস্তু হিসাবে উপস্থাপিত করে। তারপর ইউরোপ, ফিলিপিন্স হয়ে এর ব্যবহার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও শুরু হয়।
বর্তমানে ভারত হল টমেটো উৎপাদনে প্রথম স্থানাধিকারী। টমেটো প্রধানত লাল রঙের হলেও বিভিন্ন রঙের টমেটো পাওয়া যায়। পুষ্টিগুণের দিক থেকে দেখতে গেলে, টমেটো হল বিভিন্ন রকম ভিটামিন এবং খনিজের অন্যতম প্রাকৃতিক আধার। টমেটোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামি-K , B1, B3, B6, B7 এবং ভিটামিন-C থাকে। সেই সঙ্গেই থাকে আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোলিন (Choline), ফোলেট (Folate), জিঙ্ক এবং ফসফরাস।
আসুন জেনে নিই, নিয়মিত টমেটো খাওয়ার ১০টি আশ্চর্যজনক উপকারিতা –
Table of Contents
১) ত্বক, চুল ও চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সাহায্য করে –
বায়ুদূষণের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি আমাদের ত্বক ও চুলের প্রভূত ক্ষতি করে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় টমেটো যোগ করলে, এক্ষেত্রে বেশ কিছু লাভ পাওয়া যায়। টমেটোর মধ্যে থাকে লাইকোপিন (Lycopene), যা কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে সানবার্ন থেকে ত্বককে রক্ষা করে।
স্যালাড এবং তরকারির সঙ্গে খাওয়া ছাড়াও এটিকে ভালো করে ধুয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখমণ্ডলে লাগানো যেতে পারে। এতে ত্বকের ময়লা দূর হয় এবং রুক্ষতা দূর হয়ে ত্বকে সজীবতা ফিরে আসে।
টমেটোতে ভিটামিন-A থাকায় এটি চুলের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। টমেটোতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন-C ত্বকের বয়স বাড়ার হারকে বাধা দেয়। তাই উজ্জ্বল ও সুন্দর ত্বকের জন্য প্রতিদিনের খাবারে টমেটোকে রাখতেই হবে। তাছাড়া ভিটামিন-A, লাইকোপিন, লুটিন থাকার কারণে টমেটো চোখের স্বাস্থ্যের জন্যও বিশেষ উপকারী।
২) টমেটোতে রয়েছে অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক উপাদান –
গবেষণায় দেখা গেছে, টমেটোতে থাকে লাইকোপিন নামের এক যৌগ যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষত প্রোস্টেট, ফুসফুস এবং পাকস্থলীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী। আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমিয়ে দেয় টমেটোতে থাকা ক্যারোটিনয়েড (Carotenoids)।
৩) টমেটো হাড়ের জন্যও ভালো –
আমেরিকান কৃষি দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম টমেটোতে প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। তাছাড়া এতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-K থাকে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-K এর প্রাচুর্যের জন্য নিয়মিত টমেটো খেলে হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যাগুলি কম হয় এবং আপনার হাড়কে মজবুত রাখে।
৪) টমেটো ধূমপানজনিত ক্ষয়পূরণে সহায়তা করে –
টমেটোতে থাকে কিউম্যারিক অ্যাসিড এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড যা সিগারেট তথা ধূমপানজনিত ক্ষয়পূরণে সাহায্য করে।
৫) টমেটো ভালো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট –
টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-A, ভিটামিন-C সহ অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। আবার এই ভিটামিনদুটি দেহের ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলগুলিকে দেহ থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। তাই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে টমেটো ব্যবহারের কথা বলা হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে টমেটো স্যালাড হিসাবে কাঁচা খাওয়াই ভালো, কারণ রান্না করলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভিটামিন-C সাধারণত নষ্ট হয়ে যায়।
আরও পড়ুন –
৬) হার্ট বা হৃৎপিন্ডকে ভালো রাখে –
আগেই বলা হয়েছে, টমেটোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। তাছাড়া থাকে ফোলেট, ভিটামিন-A, ভিটামিন-B, লাইকোপিন। টমেটোতে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ কমাতে এবং লাইকোপিনসহ অন্যান্য উপদানগুলি রক্তে LDL তথা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এবং রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করতে সাহায্য করে। তাই হার্ট বা হৃৎপিন্ড সম্বন্ধিত রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের ডায়েটে টমেটোকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়ে থাকে।
৭) পরিপাকতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে –
পরিপাকতন্ত্রের ক্ষমতা ও লিভারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে টমেটো সাহায্য করে। টমেটোতে প্রচুর ফাইবার থাকায়, এটি মলের পরিমাণ বাড়ায় এবং কোষ্টকাঠিন্য হওয়া প্রতিরোধ করে। তাই প্রতিবার খাওয়ার সময় স্যালাড হিসাবে টমেটোকেও অন্তর্ভুক্ত করুন।
৮) রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে –
গবেষণায় দেখা গেছে টমেটোতে অল্প পরিমাণে ক্রোমিয়াম থাকে যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাছাড়া টমেটোতে থাকে আলফা-লিপোইক অ্যাসিড যা শর্করা তথা গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তরে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে টমেটোকে প্রতিরোধক খাদ্য হিসাবে গণ্য করা যায়।
৯) ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় টমেটো –
তাজা টমেটোর জুস আপনার রোগ প্রতিরোধ করতে বিশেষ কার্যকরী। ভরপুর ভিটামিন-C থাকার কারণে, আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে আপনি সারাদিন তরতাজা ও সুস্থ থাকেন।
১০) ফ্যাট তথা মেদ ঝড়াতে টমেটো বিশেষ কার্যকরী –
দেহের অতিরিক্ত ফ্যাট বা মেদ ঝড়িয়ে রোগা হওয়ার জন্য আপনি যদি ডায়েটে থাকেন, তবে প্রতিদিনের ডায়েটে টমেটোকে অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। কারনিটিন (Carnitine) নামের অ্যামিনো অ্যাসিডের উৎপাদন বাড়াতে টমেটো সাহায্য করে। আবার কারনিটিন নামের এই অ্যামিনো অ্যাসিড ফ্যাটের জারণে তথা মেদ ঝড়াতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিনের খাবারে টমেটো যোগ করলে ফ্যাটের জারণ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে আপনার ওজনও হ্রাস পায়।
সুতরাং বলাই যায়, টমেটো শুধুমাত্র খেতেই উপাদেয় নয়, স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগীও বটে। টমেটোর নানাবিধ উপকারিতার কারণে আমাদের সার্বিক সুস্থতার জন্য টমেটো খাদ্য হিসাবে খুব উপযোগী।
তাই, আজ থেকেই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় টমেটোকে অবশ্যই রাখুন। স্যালাড হিসাবে টমেটো ব্যবহার করলে, টমেটোকে ভালো ভাবে ধুয়ে নেবেন। স্যালাড ছাড়া এটিকে রান্না করেও খাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটি বাঙালি পরিবারেই তরকারি তৈরিতে টমেটো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া সকালের দিকে টাটকা তাজা টমেটোর জুস করেও খাওয়া যায়। তবে টমেটো জুস একদম খালি পেটে খাবেন না।
সুস্থ থাকবেন, আনন্দে থাকবেন।
Pingback: সুপার ফুড 'সজিনা পাতা' – জেনে নিন সজিনা পাতার অত্যাশ্চর্য সব উপকারিতা
Pingback: জাম খাওয়ার ৯ টি উপকারিতা ৷ জামের পুষ্টিগুণ - শরীর ও স্বাস্থ্য
Pingback: ওজন বাড়ানোর জন্য কী কী খাবেন? | ওজন বাড়ানোর জন্য খান এই ১৫টি খাদ্য
Pingback: ওজন বাড়ানোর জন্য কী কী খাবেন? | ওজন বাড়ানোর জন্য খান এই ১৫টি খাদ্য
Pingback: আদার উপকারিতা | জেনে নিন, আদা খাওয়ার ১০টি উপকারিতা
Pingback: কাঁচা লঙ্কা খাওয়ার ১২টি উপকারিতা | কাঁচা লঙ্কার পুষ্টিগুণ
Pingback: বগলের কালো দাগ দূর করার উপায় | বগলের কালো দাগ দূর করার ঘরোয়া উপায়
Pingback: মাসিকের ব্যথা বা ডিসমেনোরিয়া (Dysmenorrhoea) কমানোর জন্য কী করণীয়?
Pingback: সাদাস্রাব হলে কী করবেন? | সাদাস্রাবের কারণ ও প্রতিকার