ভারতে নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। তবে শুধু ভারতে না, পুরো বিশ্বেই এই সংক্রমণ বাড়ছে। অনেক জায়গায় নতুন করে লকডাউন শুরু করতে হচ্ছে, বন্ধ করতে হচ্ছে বিমান পরিষেবা, বন্ধ হচ্ছে সীমানা। যা সচেতন নাগরিক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্য-আধিকারিকসহ অনেকেরই মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রাজ্যেও পুনরায় লকডাউন ঘোষণার আশঙ্কা নিয়ে ট্রেনে-বাসে অনেকেই কানাঘুষো করছেন নিজেদের মধ্যে।
সম্প্রতি ভিড় এড়াতে গুজরাট, কর্ণাটক এবং রাজস্থান সরকার হোলি উৎসবসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর, এই কানাঘুষোর স্বর আরও জোরালো হয়েছে। নতুন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ২৮ মার্চ থেকে মহারাষ্ট্র সরকার নাইট কার্ফিউ শুরু করতে চলেছে। অনেক জায়গায় অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল কলেজ পুনরায় বন্ধ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও প্রশাসনকে দোল বা হোলি উৎসবে ভিড় যাতে না হয় সেই সম্পর্কে খেয়াল রাখতে বলেছে।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পশ্চিমবঙ্গে ভোট-উৎসব মেটার পরেই হয়তো পুনরায় লকডাউন ঘোষণা করা হবে। যদিও করোনা ভাইরাস-এর সংক্রমণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও এই ভোটের আবহে লকডাউন সম্পর্কিত কোনো খবর সরকারি সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ক্ষেত্রে প্রথম ওয়েভের থেকেও দ্বিতীয় ওয়েভে এই ভাইরাস আরও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে সকলের মধ্যে। করোনা ভাইরাসের অনেকগুলি পুরানো ও নতুন স্ট্রেইন এই সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই কারণেই সকলের মনে পুনরায় লকডাউনের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে। কারণ, ভারতে ভ্যাক্সিনেশনের হার মোট জনসংখ্যার নিরিখে এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট কম। ভ্যাকসিনের সমস্ত কোর্স কমপ্লিট হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৬১%।
ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা যেমন আছে সচেতনার অভাবের কারণে অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে চাইছেন না। ভারতে সাধারণত কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন টীকা দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই এই ভ্যাকসিনদুটির কার্যকারিতা নিয়েও সন্দিহান। তাই ভ্যাকসিন নিতে চাইছেন না।
তবে চিকিৎসকদের মতে, ১৮ বৎসরের ঊর্ধ্বে যে কেউ ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। শুধু যাঁরা কোন Acute রোগে, যেমন- জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, নতুন হার্ট অ্যাটাক, একিউট কিডনী ফেইল্যুর, একিউট লিভার ফেইল্যুর, নতুন ব্রেন স্ট্রোক, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভুগছেন তাঁরা আপাতত ভ্যাকসিন নেবেন না। তবে Acute illness এর ধাক্কা কেটে গেলে ভ্যাকসিন নেওয়া যেতে পারে। এমনকি গর্ভবতী মাও টিকা নিতে পারবেন।
আরও পড়ুন :
১) নাক ডাকার কারণ, সমস্যা ও সমাধান
২) বিয়ের আগে কী কী মেডিকেল টেস্ট জরুরী
এদিকে করোনা ভাইরাসের নিত্য নতুন শক্তিশালী স্ট্রেইন চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে বই কমাচ্ছে না! দেখা যাচ্ছে নতুন স্ট্রেইন আগের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন উপসর্গ। জ্বর, শুকনো কাশি, স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যাধিক ক্লান্তি, খিদে না পাওয়া, গলা ব্যথা, পেশির ব্যাথা, ডায়রিয়া, গায়ে র্যাশ বের হওয়া ইত্যাদি।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরিসংখ্যান :
ভারতে নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা ২৬ মার্চ শুক্রবার ছিল ৫৯,১১৮ জন যা ১৭ই অক্টোবরের পর সর্বাধিক। অথচ গত ১ লা মার্চ নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই সংখ্যাটাই ছিল মাত্র ১২,২৮৬ জন। অর্থাৎ মাত্র ২৫ দিনে নতুন করে করোনা সংক্রমণের দৈনিক সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে। এই বছর সবথেকে কম নতুন সংক্রমণ ছিল গত ২রা ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৮,৬৩৫ জন।
মহারাষ্ট্র, কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু এই পাঁচটি রাজ্যে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সর্বাধিক হলেও পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। এই রাজ্যেও নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতা তথা হাওড়া ও দুই চব্বিশ পরগনায় করোনা আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। বিভিন্ন কোভিড হাসপাতালেও খালি শয্যা সংখ্যা ক্রমশ কমছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১ লা মার্চ পশ্চিমবঙ্গে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১৯৮ জন। কিন্তু ২৬ মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেই সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৪৬ জন।
সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ :
বিধানসভা নির্বাচন তথা ভোট-উৎসবের আবহে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সাবধানতা বা সতর্কতা প্রায় একদমই মানা হচ্ছে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর রুটি-রোজগারের তাগিদে ট্রেনে-বাসে ভিড় তো হচ্ছিলই। তবে সেই সব ভিড়কে ছাপিয়ে গেছে ভোটের প্রচার জনিত জমায়েত। সেই সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে, সব জায়গাতেই সচেতনতা বা সাবধানতার অভাব – তা ট্রেন-বাসের ভিড়ই হোক বা রাজনৈতিক জমায়েত। যা এই করোনা নামক মহামারীর বিস্তারকে পুনরায় ত্বরান্বিত করছে।
দূরত্ববিধি মানার দিন অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। ইদানিং ট্রেনে-বাসে বা রাজনৈতিক সমাবেশ সব জায়গাতেই অনেকের মুখে মাস্কও দেখা যাচ্ছে না। অনেকের মাস্ক থাকলেও নাক-মুখ বাদ দিয়ে তা চিবুকে ঝুলছে। আর ঘন ঘন হ্যান্ড-স্যানিটাইজার বা হ্যান্ড ওয়াশ বা সাবান ব্যবহারের কথা ছেড়েই দিন। ওসব এখন ডালগোনা কফির মতোই অতীতের স্মৃতি।
আশঙ্কার শুরু এখান থেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় “ডালগোনা কফি” বা “আমরা কি চা খাব না”-র পুরানো স্মৃতির মতোই অনেকের মনেই নতুন করে লকডাউনের স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। অথচ সাধারণ জনসাধারণ সচেতন তো হচ্ছেই না, সঙ্গে ভয়ও পাচ্ছেন না। ফলে সতর্কতার পরিবর্তে আমজনতার গা-ছাড়া মনোভাবই বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সতর্ক না হলে করোনা ভাইরাসের এই দ্বিতীয় ওয়েভ আরও মারাত্মক ভাবে সুনামির আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে অদূর ভবিষ্যতে।

সংক্রমণ রোধে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা :
পশ্চিমবঙ্গসহ মোট পাঁচটি রাজ্যে ভোটের মরসুমে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যাতে লাগামছাড়া না হয়, তার জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। এই নির্দেশিকা প্রধানত প্রশাসন, ভোটকর্মী, ভোটার ও ভোটপ্রার্থীদের উদ্দেশ্যে।
- প্রতি বুথে ভোটারদের থার্মাল স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
- থার্মাল স্ক্যানারের সঙ্গে সঙ্গে স্যানিটাইজার, পিপিই সেট, ফেস শিল্ড, গ্লাভস, মাস্কসহ বিভিন্ন জিনিস ভোটকর্মীদের সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- সেই সঙ্গে এও বলা হয়েছে যে, ব্যবহৃত সরঞ্জাম নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে নষ্ট করতে হবে বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- করোনা সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রতি বুথে এই সম্পর্কিত পোস্টার লাগানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
- রাজনৈতিক দলগুলিকে কোভিড প্রটোকল মানার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- কোভিড নির্দেশিকা না মানলে ভোটাররা ভোটদান করতে পারবেন না।
- ভোটদানের সময় দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে, এই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখার কথাও বলা হয়েছে।
যদিও ভোটের আবহে সতর্কতা কমছে, ভিড় বাড়ছে, সেই হারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যাও। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যাবৃদ্ধিতে অনেকেই ধারণা করছেন এই রাজ্যসহ পাঁচ রাজ্যে ভোট উৎসব মিটলেই হয়তো আবার লকডাউন ঘোষণা করা হবে। বেশ কিছু জায়গা কন্টেইনমেন্ট জোন হিসাবেও ঘোষণা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও, এসবই অনেকের ধারণা, সরকারি ঘোষণা নয়। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে এখুনি সতর্ক না হলে, লকডাউনের এই ধারণা বা আশঙ্কাও অমূলক নয়।