ওজন বাড়ানোর জন্য কী কী খাদ্য খাওয়া দরকার এই নিয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। ইন্টারনেটে ওজন কমানো সংক্রান্ত হাজার হাজার শব্দের ছড়াছড়ি। কিন্তু ওজন বাড়ানোর জন্য কোন খাদ্য উপযোগী তা নিয়ে খুব অল্পই লেখা আছে। যেগুলি লেখা আছে, তার মধ্যে কার্যকরী বা স্বাস্থ্যসম্মত লেখার সংখ্যাও নামমাত্র।
প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজন থাকা অনেক শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। বয়স ও উচ্চতার তুলনায় যাঁদের ওজন কম, ওজন বাড়ানোর জন্য তাঁরা কত কী-ই না করে থাকেন। কিন্তু সঠিক উপায় না জানার জন্য অধিকাংশেরই ওজন বাড়ে না। অনেকে মনে করেন বেশি বেশি খেলেই হয়তো ওজন বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার অনেকে মনে করেন ভিটামিন ট্যাবলেট খেলেই হয়তো মোটা হওয়া যায়। কিন্তু এগুলির কোনোটাই যথাযথ নয়। ভিটামিন ও খনিজ লবণ শরীরকে কার্যক্ষম করে খাওয়ার রুচি বাড়ায়। কিন্তু ওজন বাড়ানোর জন্য শর্করা, প্রোটিন ও ফ্যাটজাতীয় খাবারের সুষম ব্যালেন্স রাখা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার দিনে একাধিক বার খাওয়া, পেট খালি না রাখা। উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ ওজন বাড়ানোর অন্যতম চাবিকাঠি।
Table of Contents
ওজন বাড়ানোর জন্য কী কী খাবেন?
কোন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার না করে শুধুমাত্র বাড়ির খাবার খেয়েই ওজন বাড়ানো সম্ভব। অপরিকল্পিত ভাবে সাপ্লিমেন্ট বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে আপনার ওজন বাড়লেও, নানান শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। যা অনভিপ্রেত। তাই ওজন বাড়ানোর জন্য কী কী খাওয়া উচিত সেই নিয়েই আজকের আলোচনা। ওজন বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু খাদ্যের কথা এখানে বলা হল –
১) ডিম
পেশীবহুল শরীর তৈরির জন্য ডিম হল অন্যতম একটি খাদ্য। ডিমে থাকে উচ্চমানের ভালো প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া ডিম বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিনে ভরপুর। ডিমের সাদা অংশে অ্যালবুমিন ও গ্লোবিউলিন এবং কুসুমে ফসফোপ্রোটিন থাকে। ডিমের কুসুম হল স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের অন্যতম উৎস। তাই ওজন বাড়াতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিম রাখুন।
চাহিদা অনুযায়ী দিনে এক বা একাধিক ডিম খাওয়া যেতে পারে। অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলে, দিনে দুই-তিনটে ডিম খাওয়াই যায়। অনেক অ্যাথলেটিকরা দিনে ছয়টা বা তার বেশিও ডিম খান।
২) ভাত ও রুটি
ভাত ও রুটি হল কম খরচের সবথেকে ভালো শর্করা বা কার্বোহাইড্রেটের উৎস, যা আপনার ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। ভাত বা রুটি ওজন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সহজে হজমও হয়, যা আপনার ক্যালোরির চাহিদা পূরণ করে।
ভাত বা রুটির সঙ্গে অন্যান্য সবজি, প্রোটিন ও ফ্যাট যোগ করে উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খুব ভালো ব্যালেন্সড ডায়েট বানানো সম্ভব। মাছ, মাংস, ডিম, মাখন, ঘি, ডাল বা বিভিন্ন সবজি সহযোগে ভাত বা রুটি খাওয়া যেতে পারে। যা প্রয়োজনীয় পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়াতে খুবই কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে থাকে।
৩) বাদাম
স্বাস্থ্যকর ভাবে ওজন বাড়াতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অল্প বাদাম রাখুন। বিকাল বা সন্ধ্যার স্নাক্সে অল্প বাদাম আপনার মুড ভালো করার সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়াতেও সাহায্য করে। বাদামে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি অ্যাসিড, ফাইবার, প্রোটিন ও ভিটামিন-ই। বাদামে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি থাকায়, একমুঠো বাদাম থেকেই প্রচুর ক্যালোরি পাওয়া যায়, যা আপনার ওজন বাড়াতে সাহায্য করে।
কাঁচা বা ভাজা বাদাম বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া চিনিবিহীন ও হাইড্রোজেনেটেড তেলবিহীন নাট বাটার (Nut Butters) রুটি বা পাউরুটির সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। সকালের এক্সারসাইজের পর যা খুবই ভালো একটা খাবার। তাছাড়া প্রোটিনযুক্ত বিভিন্ন smoothies বা পানীয় বানাতে বাদাম বা Nut Butters ব্যবহার করা যায়।
৪) দুধ
অতি প্রাচীনকাল থেকেই পেশীবহুল শরীর ও ওজন বৃদ্ধির জন্য দুধ খাওয়ার প্রচলন চলে আসছে। প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করার সঠিক ভারসাম্য দুধে উপস্থিত। সেই সঙ্গে দুধ হল ক্যালসিয়াম, অন্যান্য খনিজ ও ভিটামিনের খুব ভালো উৎস। তাই স্বাস্থ্যকর ভাবে ওজন বাড়ানোর জন্য দুধ খাওয়া প্রয়োজনীয়।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ওয়েট লিফটিং জাতীয় শরীরচর্চার সঙ্গে নিয়মিত দুধ খেলে পেশীর গঠন ভালো হয়। শরীরচর্চার আগে বা পরে দুধ খাওয়া অন্যান্য প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরিবর্তে বেশি উপকারি। পেশীর গঠনের পাশাপাশি দেহের ওজনবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়।
দুধ দিয়ে বিভিন্ন পানীয় (Milk smoothies) তৈরি করে, দুধকে আপনার ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৫) মাখন ও ঘি
স্নেহজাতীয় পদার্থ ওজন বাড়াতে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাই ওজন বাড়াতে মাখন ও ঘি এর মতো স্নেহজাতীয় খাদ্যগ্রহণ আবশ্যিক। তবে মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। খাদ্যগ্রহনের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি। তাই কোলেস্টেরল বা হার্টের সমস্যা থাকলে মাখন বা ঘি খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬) পনির
মাখন ও ঘি-এর মতোই দুগ্ধজাত এই খাদ্যটিও ওজন বাড়াতে খুবই কার্যকরী। উচ্চ ক্যালোরি, পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ফ্যাটযুক্ত হওয়ায় খুব অল্প পরিমাণ পনির নিয়মিত খাওয়ার ফলে ওজন বাড়ে। তাছাড়া পনিরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড়ের গঠনের জন্য খুবই উপকারি।
৭) দই
ওজন বাড়ানোর জন্য দই-ও খুব ভালো একটা খাদ্য। দুপুর বা রাত্রে খাবার খাওয়ার পর শেষ পাতে দই খাওয়ার চল বহুদিনের। তাছাড়া দই দিয়ে অনেক ভালো ভালো রেসিপিও বানানো যায়। দইয়ে থাকে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ফ্যাট। তাই দইকে অন্যতম পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবেও ধরা হয়। তবে ফ্লেভার দেওয়া ও অতিরিক্ত মিষ্টি দেওয়া দই না খাওয়াই ভালো।
৮) মিষ্টি ফলের রস
মিষ্টি ফল এবং মিষ্টি ফলের রস হল ওজন বাড়ানোর জন্য সবথেকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান। ফলের রসে থাকা সুক্রোজ তথা চিনি আপনার ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে। তাছাড়া বিভিন্ন ফলের আরও অনেক পুষ্টিগুণ আছে, যা আপনার শরীরের সার্বিক পুষ্টির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর পদার্থগুলি শরীর থেকে বের হয়ে যায়। শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। যা স্বাস্থ্যকর ভাবে দেহের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে।
৯) শুকনো ফল
খেঁজুর, কিশমিশের মতো শুকনো ফলগুলিতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা তথা ক্যালোরি বর্তমান। এই জাতীয় শুকনো ফলগুলি স্নাক্স হিসাবে খাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যকর ভাবে ওজন বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া বিভিন্ন খনিজ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায়, খেঁজুর ও কিশমিশ জাতীয় শুকনো ফলগুলির পুষ্টিমূল্যও বেশি।
১০) আলু ও স্টার্চজাতীয় খাবার
মোটা হওয়ার জন্য বেশি বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন। সেই হিসাবে আলুসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর স্টার্চজাতীয় খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ এইগুলির সহজলভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে পকেট-সাশ্রয়ী গুণও আছে। স্বাস্থ্যকর স্টার্চজাতীয় খাবার যেমন – আলু, কুমড়ো, লাউ, ভুট্টা, বিভিন্ন বিনস্ ইত্যাদি শুধুমাত্র ক্যালোরির যোগান দিয়ে ওজনই বাড়ায় না; সেইসঙ্গে পেশিতে গ্লাইকোজেন সঞ্চয় করতেও সাহায্য করে। এইসব খাদ্যগুলি অন্যান্য পুষ্টিগুণ ও ফাইবারে ভরপুর হওয়ায় সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্যও বিশেষ উপকারি।
আরও পড়ুন : (১) টমেটো খাওয়ার উপকারিতা, সজিনা পাতার উপকারিতা (২) উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন কীভাবে?
১১) ডার্ক চকোলেট
অন্যান্য উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাদ্যগুলির মতোই ডার্ক চকোলেট হল একটি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য। অর্থাৎ অল্প পরিমাণ ডার্ক চকোলেট থেকেই প্রচুর পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব।
৬০ – ৭০% কোকাযুক্ত ১০০ গ্রাম চকোলেট বার থেকে প্রায় ৬০০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া চকোলেট হল ম্যাগনেশিয়াম, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো প্রচুর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে ভরপুর। ৭০% কোকাযুক্ত ডার্ক চকোলেট স্ট্রেস হরমোন ও রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। ডার্ক চকোলেট কিছু কিছু ক্যানসার, ডায়াবেটিস-২, মানসিক চাপ ও হার্টের সমস্যার ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে।
১২) তৈলাক্ত মাছ
রেড মিটের মতোই বিভিন্ন তৈলাক্ত মাছে (যেমন – সালমন) প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বর্তমান। যার মধ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ মানের প্রোটিনযুক্ত হওয়ায় এই সমস্ত মাছগুলি মাংসপেশি গঠনেও ভূমিকা নিয়ে থাকে। ১৭০ গ্রাম সালমন মাছ থেকে প্রায় ২৫০ ক্যালোরি শক্তি ও ১২ গ্রাম স্বাস্থ্যকর ফ্যাট পাওয়া যায়। তাই ওজন বাড়ানোর জন্য আপনার খাওয়ার প্লেটে তৈলাক্ত মাছগুলি যোগ করতেই পারেন।
১৩) পাস্তা ও নুডলস
পাস্তা ও নুডলস কার্বোহাইড্রেট ও ক্যালোরিতে ভরপুর হওয়ায় ওজন বাড়ানোর জন্য এগুলি খাওয়া যেতেই পারে। কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ পাস্তা ও নুডলস প্রচুর ক্যালোরির যোগান দেয় ও ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। তবে স্বাস্থ্যকর ভাবে ওজন বাড়ানোর জন্য ব্লিচড পাস্তা এড়িয়ে চলতে হবে।
১৪) রেড মিট
ওজন বাড়াতে রেড মিট খাওয়া যেতে পারে। রেড মিটে থাকে লিউসিন নামের এক অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মাংসপেশীর প্রোটিন সংশ্লেষ করতে সাহায্য করে। ১৭০ গ্রাম রেড মিটে প্রায় ৫ গ্রাম লিউসিন থাকে। তাছাড়া থাকে প্রায় ৪৫৬ ক্যালোরি শক্তি ও ৫০ গ্রাম প্রোটিন। রেড মিটে থাকা ক্রিয়েটিনও প্রোটিন সংশ্লেষ ত্বরান্বিত করে। তাই ওজন বাড়ানোর জন্য রেড মিট খাওয়া যেতে পারে। তবে অন্যান্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে রেড মিট না খাওয়াই উচিত। রেড মিটের বেশি ফ্যাটযুক্ত অংশের তুলনায় পেশীবহুল মাংসল অংশ খাওয়াই বেশি উপকারি।
১৫) ঘরে তৈরি প্রোটিনযুক্ত পানীয়
ওজন বাড়ানোর জন্য আপনি নিজেই বাড়িতে বেশ কিছু হাই-প্রোটিন স্বাস্থ্যকর পানীয় বানিয়ে নিতে পারেন। সকালে বা বিকালে ওয়ার্ক-আউট করার পর উচ্চ প্রোটিনযুক্ত পানীয় পান করা যেতে পারে। যা আপনাকে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে মাংসপেশির গঠনেও সাহায্য করে।
সহজে ওজন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রোটিন-শেক বা প্রোটিনযুক্ত পানীয় প্রস্তুত করা যায়। চকোলেট, কলা, বাদাম, দুধ, ভ্যানিলা, বেরি, মাখন প্রভৃতি দিয়ে বিভিন্ন রকমের উচ্চ প্রোটিনযুক্ত পানীয় বানানো যায়। যা ওজন বৃদ্ধিতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে থাকে।
ওপরে উল্লেখিত বিভিন্ন খাদ্যগুলি ওজন বাড়ানোর জন্য খুবই প্রয়োজনীয় খাবার। কোনো রকম ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার না করে শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাবার খেয়েই ওজন বৃদ্ধি হলে পরবর্তীকালে শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার ভয় থাকে না। তাই ওজন বাড়ানোই যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়, তবে উল্লেখিত খাদ্যগুলি নিয়মিত খেয়ে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে বা কোনো রকম শারীরিক অসুবিধা থাকলে আপনার ডাক্তার বা ডায়েটেশিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন।