You are currently viewing হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ
উচ্চ রক্তচাপের কারণ

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ

ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) বা হাইপারটেনশন (Hypertension) এমন একটি সমস্যা যা বর্তমান সময়ে অনেকেরই দেখা যায়। রক্তবাহের গায়ে প্রবাহমান রক্তের চাপ স্বাভাবিকের থেকে বেশি (150/90 mm Hg) হওয়াকে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জন্য আগে জেনে নেওয়া দরকার উচ্চ রক্তচাপের কারণ গুলি কী কী?

হৃৎপিন্ড থেকে পাম্প করার মাধ্যমে রক্তবাহের মধ্যে দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্তবাহের দেওয়ালে এক পার্শ্বচাপ দেয়, একে রক্তচাপ বলে। এই রক্তচাপের মান সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক প্রেসার নামে দুটি অংশে একত্রে লেখা হয়ে থাকে। নিলয়ের সঙ্কোচনকালে হার্টের পাম্প করার ফলে রক্ত রক্তবাহের গায়ে যে চাপ দেয়, তাকে সিস্টোলিক চাপ বলে। দুটি পাম্প করার মাঝে রক্তবাহের গায়ে রক্ত যে চাপ দেয়, তাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে।

স্ফিগমোম্যানোমিটার যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তচাপ মাপা হয় এবং millimeters of mercury এককের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক প্রেসারের মান যথাক্রমে 120 mm Hg এবং 80 mm Hg (+/- 15)। সাধারণ ভাবে যা 120/80 mm Hg এইভাবে লেখা হয়।

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সাধারণত বহুদিন ধরে অল্প অল্প করে গড়ে ওঠে। প্রাথমিক অবস্থায় কোনো সিম্পটম বা লক্ষণ না থাকায়, এটি সহজে ধরা পরে না। কিন্তু সিম্পটম ছাড়াই এটি অনেক ক্ষতির সৃষ্টি করে থাকে। তাই একটা বয়সের পর (মোটামুটি ৩৫-৪০ বছর) নিয়মিত রক্তচাপ দেখে নেওয়া উচিত। প্রাথমিক অবস্থায় জীবনশৈলীর সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনের মাধ্যমেই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়

তবে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন দীর্ঘস্থায়ী হলে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওরের মতো মারাত্মক সমস্যার ঝুঁকি থাকে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। অথচ অধিকাংশ মানুষই নিজের উচ্চ রক্তচাপ এবং এর কারণ সম্পর্কে অবহিত নন। কিংবা অবহিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সচেষ্ট নন।

Table of Contents

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ

চিকিৎসাশাস্ত্রে সাধারণত দু’ধরণের হাইপারটেনশনের কথা বলা হয়ে থাকে। একটি অত্যাবশ্যক উচ্চ রক্তচাপ তথা Essential Hypertension (বা Primary Hypertension)। অন্যটি হল কারণজাত উচ্চ রক্তচাপ তথা Symptomatic Hypertension (বা Secondary Hypertension)।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ

প্রাইমারি হাইপারটেনশন (Primary Hypertension) এবং এই ধরণের উচ্চ রক্তচাপের কারণ

প্রাইমারি হাইপারটেনশন (Primary Hypertension)-কে অত্যাবশ্যক উচ্চ রক্তচাপ (Essential Hypertension)-ও বলা হয়ে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ মানুষের এই সমস্যা দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্তচাপ বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঠিক কী কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সম্পর্কে এখনও ধোঁয়াশা আছে। তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কারণ শনাক্ত করা সম্ভবপর হয় না। তবে বেশ কিছু ফ্যাক্টর যে এই রক্তচাপ বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে, তা নিশ্চিত। যেমন –

পারিবারিক কারণ বা বংশগত (Family History) :

পরিবারের মধ্যে (মা ও বাবা উভয়ের বংশেই) উচ্চ রক্তচাপের অতীত ইতিহাস থাকলে কেউ কেউ উচ্চ রক্তচাপের শিকার হন। পারিবারিক ভাবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা অনেকেরই দেখা যায়।

জিনগত কারণ (Genetic Factor) :

Heterozygous genus মানুষের চেয়ে Homozygous genus-এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়।

বয়স (Age) :

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা যায়। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পর থেকেই সাধারণত এই সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

লিঙ্গ (Gender) :

মহিলা অপেক্ষা পুরুষরা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় বেশি ভোগেন।

জাতি (Race) :

পৃথিবীর বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে আমেরিকান, আফ্রিকান নিগ্রো ও জাপানিদের মধ্যে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বেশি দেখা যায়।

মোটা হয়ে যাওয়া (Being Overweight or Obese) :

হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম কারণ মোটা হয়ে যাওয়া। আপনি যত মোটা হবেন, দেহে অক্সিজেনের সঞ্চালন তত বেশি দরকার। তাই হার্ট বেশি পাম্প করতে থাকে। তাছাড়া রক্তবাহের গায়ে স্নেহপদার্থ জমে রক্তবাহ সরু হয়ে যায়। ফলস্বরূপ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়।

★ আরও পড়ুন – ওজন কমানোর কিছু কার্যকরী উপায়

শারীরিক কসরত না করা (Being physically inactive) :

শারীরিক কসরত না করাও হাইপারটেনশনের একটি কারণ। তাছাড়া শারীরিক কসরত না হওয়ার কারণে মোটা হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়, যা পরোক্ষভাবে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী।

তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ ( Tobacco inteke) :

ধূমপান বা অন্যকোনো ভাবে তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ করা শুধু মাত্র রক্তচাপ বাড়ায় তাই নয়। সেই সঙ্গে হৃৎপিন্ডের মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করার জন্যও দায়ী। তোমাকে থাকা রাসায়নিক রক্তবাহের দেওয়ালের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং রক্তবাহের প্রস্থ সরু করে দেয়। ফলে হৃদরোগের সম্ভবনা বৃদ্ধি পায়। এমনকি পরোক্ষ ধুমপায়ীরাও এই ক্ষতি থেকে রেহাই পান না!

লবণ বেশি খাওয়া (Salt intake) :

যে সমস্ত মানুষ বেশি মাত্রায় লবণ গ্রহণ করেন, অন্যদের তুলনায় তাঁদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ বেশি দেখা যায়। লবণে থাকা সোডিয়ামকে এর জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।

মদ্যপান (Drinking Alcohol) :

দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মদ্যপান হৃৎপিন্ডের ক্ষতি করে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন সৃষ্টি করে।

মানসিক চাপ (Stress) :

অত্যাধিক মানসিক চাপ উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ। মানসিক চাপের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের সমস্যাকে ত্বরান্বিত করে।

অধিক সক্রিয় সিমপ্যাথেটিক নার্ভ :

সিমপ্যাথেটিক নার্ভ যাঁদের মধ্যে বেশি সক্রিয় তাঁদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা যায়।

আরও পড়ুন : কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিবর্তন করুন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা

সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (Secondary Hypertension) এবং এই ধরণের উচ্চ রক্তচাপের কারণ

প্রাইমারি হাইপারটেনশন যেমন ধীরে ধীরে তৈরি হয়, সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন ঠিক এর বিপরীত। সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন সাধারণত হঠাৎ করেই গড়ে ওঠে এবং এটি প্রাইমারি হাইপারটেনশনের থেকেও মারাত্মক রূপ নিতে পারে। সাধারণত সুনির্দিষ্ট কিছু শারীরিক সমস্যা বা কারণের জন্য সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন গড়ে ওঠে। তাই সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনকে লক্ষণজাত বা কারণজাত উচ্চ রক্তচাপও (Symptomatic Hypertension) বলা হয়ে থাকে।

কিডনির বিভিন্ন সমস্যা, হরমোনের তারতম্য, ওষুধ সেবন ইত্যাদি কারণের জন্য সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন বা লক্ষণজাত উচ্চ রক্তচাপ দেখা যেতে পারে –

বৃক্কের সমস্যা (Kidney Disease) :

বৃক্ক বা কিডনির সমস্যার কারণে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিডনির সমস্যার কারণে রেনিন নামক হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই রেনিন পরোক্ষভাবে রক্তচাপ বৃদ্ধি করায়। কিডনির মধ্যে সিস্ট গঠিত হলে কিডনির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। সেই কারণেও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া ডায়াবেটিস জনিত কারণেও বৃক্ক বা কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা পরোক্ষ ভাবে উচ্চ রক্তচাপের কারণ।

অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (Obstructive Sleep Apnea) ও নাক ডাকা (Snoring) :

অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ও নাক ডাকার সমস্যার কারণে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। অক্সিজেনের অভাবে রক্তবাহের দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের একটি কারণ।

থাইরয়েডের সমস্যা (Thyroid problems) :

থাইরয়েডের সমস্যার কারণেও উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজম, যখন থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড উৎপন্ন করতে পারে না এবং হাইপারথাইরয়েডিজম, যখন বেশি মাত্রায় থাইরয়েড উৎপন্ন হয় – উভয়ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হতে পারে।

হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম (Hyperparathyroidism) :

শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি বেশি পরিমানে প্যারাথাইরয়েড হরমোন ক্ষরণ করলে (হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম), রক্তে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। রক্তে থাকা এই ক্যালসিয়াম রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।

ফিওক্রোমোসাইটোমা (Pheochromocytoma) :

ফিওক্রোমোসাইটোমা হল একধরনের বিরল টিউমার যা সাধারণত অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে হয়। এর ফলে অ্যাড্রিনালিন ও নর-অ্যাড্রিনালিন হরমোন দুটির ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়, যা উচ্চ রক্তচাপের কারণ।

অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির সমস্যা/ অ্যালডোস্টেরোনিজম (Aldosteronism) :

অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি অ্যালডোস্টেরন নামের একটি হরমোন ক্ষরণ করে। কোনো কারণে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি বেশি পরিমাণে অ্যালডোস্টেরন ক্ষরণ করলে, কিডনির কার্যক্ষমতা ত্রুটিযুক্ত হয়। শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন সৃষ্টি হয়।

গর্ভাবস্থা/প্রেগন্যান্সি (Pregnancy) :

উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে প্রেগন্যান্সি বা গর্ভাবস্থায় সেই সমস্যা আরও বাড়ে। তাছাড়া গর্ভাবস্থাতেও নতুন করে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যাকে প্রিক্ল্যাম্পসিয়া (Preeclampsia) বলা হয়।

কুশিং সিনড্রোম (Cushing syndrome) :

যে সমস্ত মানুষের কুশিং সিনড্রোম আছে, তাদের প্রায় ৮০% হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন।

বিভিন্ন ওষুধ সেবন (Medication) :

বেশ কিছু ওষুধ বা ভেষজ সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তৈরি হতে পারে। মানসিক সমস্যায় ব্যবহৃত বেশ কিছু ওষুধ ও কিছু ব্যাথানাশক উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধ (Birth control pills)-ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে। বেশ কিছু ভেষজ উপাদান অতিরিক্ত গ্ৰহণ করা এবং কোকেনের মতো বেশ কিছু অবৈধ ড্রাগ গ্রহণ করার ফলে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের সমস্যা দেখা যায়।


ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন

This Post Has 4 Comments

মন্তব্য করুন